স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এনআইডি

ইসি কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে ভোটার তালিকা কার্যক্রমসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। অন্যদিকে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন- ২০২৩’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন হওয়ায় অসন্তুষ্ট প্রকাশ করছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা। গত সোমবার এনআইডির খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর ইসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, সবাই এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে বিভিন্ন কারণে প্রকাশ্যে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছেন না তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির এক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে এনআইডি স্থানান্তরের বিরুদ্ধে আমরা সিইসিসহ চার কমিশনারকে স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসি সচিব জাহাঙ্গীর আলম আমাদের এক কর্মকর্তাকে অন্য কারণ দেখিয়ে শোকজ করেন। এ কারণে কেউ কিছু বলছেন না এবার। তিনি বলেন, এনআইডি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের হাতে তিল তিল করে গড়া একটি প্রতিষ্ঠান। খুবই অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে নির্বাচন কমিশন এনআইডির সেবা অব্যাহত রেখেছে। সরকারের অধীন অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের তুলনায় সবচেয়ে স্বচ্ছ সেবা দেয় এনআইডি। তারপরও আমলাদের নজর এনআইডির ওপর থেকে সরেনি। তারা যে কোনো মূল্যে এটা নিয়েই ছাড়বে। এর আগে এনআইডি নিবন্ধন অনুবিভাগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে না দিয়ে নিজেদের অধীনে রাখার জন্য কমিশনকে স্মারকলিপি দিয়েছিল বাংলাদেশ ইলেকশন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। তারা সে সময় দাবি করেন, এটি ইসির থেকে সরিয়ে নেয়া হলে নির্বাচনের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা ইভিএমের মাধ্যমে যে নির্বাচন করি, সেখানে সরাসরি এনআইডি ব্যবহার হয়। আমাদের ডেটাবেজ অন্য কোথাও থেকে এলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমানে দেশে ভোটের অবস্থা খারাপ। এনআইডি রাষ্ট্রের অন্য সংস্থার কাছে গেলে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে প্রশ্ন আরো বাড়বে। তিনি বলেন, ইসি ২০০৭ সালে এটি তৈরি করেছে, এটি অনেকটাই স্বচ্ছ যদিও তারা কিছুটা এখন অস্বচ্ছ করেছে তারপরও এটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার। তাছাড়া ইসি নিরপেক্ষ তাই এনআইডি ইসির কাছে থাকা ভালো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গেলে নানা সমস্যা দেখা দিবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার (ইসি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, এনআইডি সেবা ও কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে নেয়া হলে ভবিষ্যতে বড় সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, এনআইডি সরকার ইসি থেকে কেন নিতে চায়, তা পরিষ্কার নয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এনআইডি চলে গেলে আগামীতে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। এম সাখাওয়াত হোসেন অরো বলেন, এই এনআইডির পেছনে এতগুলো বছর একটা সিস্টেম ডেভেলপ করেছে ইলেকশন কমিশন। এটা যদি আলাদা হয়ে যায়, তাহলে কোনো একসময় ইন ফিউচারে (নিকট ভবিষ্যতে) ভোটার তালিকা নিয়ে কথা উঠবে। কারটা ঠিক? এনআইডি ঠিক নাকি ভোটার তালিকা ঠিক? আলটিমেটলি এটা নিয়ে একটা গ-গোল হবে। তিনি বলেন, যেসব দেশে এনআইডি আলাদা আছে, সেখানে ভোটার তলিকা নিয়ে বড় ধরনের গ-গোল হচ্ছে। কাজেই বর্তমান কমিশনকে এ জায়গায় সরকারকে বোঝাতে হবে। এদিকে গত সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০২৩’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে। এই আইনের ফলে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান বা নাগরিকের নিবন্ধন করার ক্ষমতা হারাবে ইসি। নতুন আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে এনআইডি দেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই আইন কার্যকর হলে নাগরিকদের পরিচয়ের নম্বর থাকবে একটিই। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীন নিবন্ধকের অফিস নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এই সংস্থার অফিস থাকবে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় এবং এসব অফিসের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যক্রম চলবে। ইসি কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সিদের ভোটার তালিকা করবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ঠিক কবে নাগাদ এটা আইনে পরিণত হবে, সেটা আমি জানি না। তবে আমরা চাই দেশের সব নাগরিকের একটাই নম্বর থাকুক। আমরা সেদিকেই যাচ্ছি। সাধারণত কোনো আইন সংসদে পাস হলেই তা কার্যকর হয়। তবে এ আইনের ক্ষেত্রে তা হবে না। তিনি আরো বলেন, এ আইনটি সংসদে পাস হলেও এখনই কার্যকর হবে না। সরকার যখন মনে করবে, তখন সিদ্ধান্ত জানালে এ আইন কার্যকর হবে। এ আইন কার্যকর হলে নাগরিকরা জন্মের পরপরই নিবন্ধন করে ফেলতে পারবেন; যা করতে হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, প্রস্তাবিত এ আইনের আওতায় নিবন্ধন অফিসের প্রধান হবেন নিবন্ধক। তার মাধ্যমে এই কাজটি (নাগরিক নিবন্ধন) হবে। এর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, যে কোনো নাগরিক জন্মের পরপরই নাগরিক সনদ বা একটি নম্বর পাবেন। এই নম্বর অপরিবর্তিত হবে। যখন একজন নাগরিক এই নম্বর পাবেন, তখন পরিচয়ের জন্য আর কোনো নম্বর লাগবে না। ভোগান্তি দূর করার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। লক্ষ্য হলো-ধীরে ধীরে এই একটি পরিচয় নম্বরেই সব তথ্য রাখা। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন পাস হওয়ার পর সরকার নির্ধারিত তারিখ থেকে নতুন নিবন্ধকের অফিসের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধকের কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর এনআইডি নিবন্ধন আইনের খসড়া নীতিগত অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। এর পর থেকেই নির্বাচন কমিশন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষমতা পাওয়া ও রাখা নিয়ে টানাটানি শুরু হয়।