ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক সামিটে প্রধানমন্ত্রী

টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে

প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান শতাব্দীর বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী একটি নতুন সামাজিক চুক্তি সম্পাদন করা একান্ত প্রয়োজন। এই সামাজিক চুক্তির মূল লক্ষ্য হতে পারে টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

গতকাল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ার্ক সামিট : ‘সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার’ এর সাধারণ অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ অতীতের বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করে একটি ন্যায়ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই সমাজ নির্মাণের পথে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। আমরা এমডিজি’র সব লক্ষ্য পূরণ করেছি। এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জনের জন্য বহুমাত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করে চলেছি। ২০২৬ সালের মধ্যে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে আমাদের চূড়ান্ত উত্তরণ ঘটবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা শ্রম খাত সম্পর্কিত ২০২১-২০২৬ সাল মেয়াদি রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করছি। শ্রম অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ আইএলও’র ১০টি মৌলিক সনদের মধ্যে আটটি অনুস্বাক্ষর করেছে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিষয়ক নতুন দুইটি মৌলিক আইএলও সনদ অনুস্বাক্ষরের বিষয়টিও আমরা সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছি।

তিনি বলেন, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, শ্রম অধিকার নিয়ে সোচ্চার কয়েকটি উন্নত দেশ এখন পর্যন্ত নিজেরা অধিকাংশ আইএলও মৌলিক সনদ অনুস্বাক্ষর করেনি। যেমন একটি বড় শিল্পোন্নত দেশ মাত্র দুটি মৌলিক সনদ অনুস্বাক্ষর করেছে। শিশু শ্রমের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণে বাংলাদেশ সম্প্রতি আইএলও সনদ ১৩৮ অনুস্বাক্ষর করেছে। ঝুঁকিপূর্ণ আটটি সেক্টরকে আমরা ‘শিশু শ্রম মুক্ত’ হিসেবে ঘোষণা করেছি। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ১ লাখ শিশু শ্রমিককে উপানুষ্ঠানিক ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম চলছে। একটি সুস্থ ও নিরাপদ আগামী প্রজন্মের স্বার্থে আমি দেশকে শিশু শ্রমের অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চাই। আইএলও’র সুপারিশ অনুযায়ী আমরা ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ দুই দফা সংশোধন করেছি। এছাড়া বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ সংশোধন করা হয়েছে। এ বছর নাগাদ শ্রম আইন, ২০০৬-এ আরও সংশোধনী আনার জন্য কাজ করছি। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ প্রয়োগের জন্য আমরা ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় অনুমোদন দিয়েছি।

সরকারপ্রধান বলেন, একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল ও সাতটি শ্রম আদালতের সঙ্গে আমরা নতুন আরো ছয়টি শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করেছি। একই সঙ্গে শ্রমিক ও মালিক পক্ষের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জোরদার করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের শিল্প কারখানাগুলোর জন্য ‘শিল্প পুলিশ’ ইউনিট গঠন করা হয়েছে। আমরা দেশের সব তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ মূল্যায়ন এবং এর ভিত্তিতে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর সংস্কার করেছি। বিশ্বের ১০০টি শ্রেষ্ঠ পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার অর্ধেকের বেশি এখন বাংলাদেশে। এ অর্জনকে আরও এগিয়ে নিতে আমরা ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড নীতিমালা’ প্রণয়ন করেছি। আমি আশা করব, আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনে এসব পরিবেশবান্ধব উদ্যোগকে আরো উৎসাহিত করবেন। আমরা একটি ‘জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করছি। ৩২টি শ্রম কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা শ্রমিকদের নিয়মিত চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। আমরা কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা ৭১১ জনে উন্নীত করেছি। আইএলও’র কারিগরি সহায়তায় একটি ওয়েবভিত্তিক ‘শ্রম পরিদর্শন ব্যবস্থাপনা অ্যাপ্লিকেশন’ চালু করা হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, পোশাক শিল্পের জন্য একটি স্বতন্ত্র ত্রিপক্ষীয় পর্যালোচনা পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। আমাদের সরকারই পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৮ হাজার টাকায় উন্নীত করেছে। বিভিন্ন শিল্প খাতে সমন্বিত দর কষাকষির মাধ্যমে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের লক্ষ্যে নীতি কাঠামো প্রণয়নের বিষয়টি আমাদের বিবেচনাধীন রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন অনলাইন করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের হার ২০১৩ সালের ৬০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২২ সালে ৯০ শতাংশ হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প খাতে ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা গত ৯ বছরে ৯ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমিক এবং নিয়োগকর্তাদের ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ওপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ইপিজেড এবং নন-ইপিজেড এলাকার জন্য দুটি পৃথক টোল-ফ্রি হেল্পলাইন চালু করা হয়েছে। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা প্রদানে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার জন্য পোশাক শিল্প শ্রমিকদের তথ্যসম্বলিত ডাটাবেজ প্রণয়ন করা হচ্ছে। নারী শ্রমিকদের মাতৃত্ব সুরক্ষায় চার মাসের মজুরিসহ ছুটি ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম শিল্প এলাকায় ১ হাজার ৫৩০ কর্মজীবী মহিলা শ্রমিকের জন্য স্বল্পমূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া, বিভিন্ন শিল্পকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে ৬ হাজার ৪৩০টি ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সহিংসতা বা হয়রানির বিরুদ্ধে আমরা শূন্য-সহিষ্ণুতা দেখানোর নির্দেশ দিয়েছি। সম্প্রতি নারীদের অবৈতনিক গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডকে জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য আমি নির্দেশনা দিয়েছি। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের আওতায় শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন খাতে আর্থিক সহায়তা লাভ করছে। সেই সঙ্গে রপ্তানিমুখী শিল্পখাতে কর্মরত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘কেন্দ্রীয় তহবিল’ গঠন করা হয়েছে। তৈরি পোশাকখাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ২০২২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ‘অ্যামপ্লয়মেন্ট ইনজুরি ইনস্যুরেন্স স্কিম’ চালু করা হয়েছে। প্রতি বছর ২০ লাখ তরুণ-তরুণী আমাদের শ্রমবাজারে নতুনভাবে প্রবেশ করছেন।

তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ১ কোটি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা দেশজুড়ে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছি। সেই সঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ৩৯টি হাই-টেক পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আওতায় আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৫২ হাজার এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ২ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। আমরা রূপকল্প-২০৪১ অনুযায়ী ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ উদ্দেশ্যে গবেষণা ও উদ্ভাবন খাতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ৯ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ও ইনোভেশন সেন্টারের মাধ্যমে ৮০ হাজার তরুণ-তরুণীকে অগ্রসর প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। দেশের সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারকে নিবন্ধনের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতির মূলধারায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আমরা কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতকে সহজশর্তে ঋণ, পুনঃঅর্থায়ন ও বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করছি। কোভিড-১৯ অতিমারির ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক সিএমএসএমই খাতে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পুনঃঅর্থায়ন স্কিম চালু করেছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বর্তমানের ১৭ শতাংশ থেকে উন্নীত করে ৩০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। আমাদের তরুণদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপযোগী করে গড়ে তুলতে আমরা সমুদ্র গবেষণা, বিমান প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, ন্যানো প্রযুক্তি ও ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছি। সার্বিকভাবে অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা এবং প্রবাসীদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের জন্য আমরা ‘প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেছি। বাংলাদেশ নিরাপদ, সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত অভিবাসন নিশ্চিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সম্ভাব্য অভিবাসনসহ সামগ্রিক কর্মপরিবেশে এর প্রভাব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছি।

সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের সরকার জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক অংশীজনদের সঙ্গে আরো আলোচনার মাধ্যমে এ বৈশ্বিক জোটে যোগদানের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি পাঁচটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে চাই-

এক. এই জোটকে একটি মান-নির্ধারক বা দরকষাকষির ফোরাম হওয়ার পরিবর্তে একটি পরামর্শমূলক বা অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে গড়ে তোলাই বাঞ্ছনীয় হবে।

দুই. বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’-কে এক আন্তর্জাতিক মহল কর্তৃক অন্য মহলের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে এই জোটকে সতর্ক থাকতে হবে।

তিন. এই জোটকে একটি নিয়মতান্ত্রিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার আওতায় সামাজিক ন্যায়বিচারকে একটি রক্ষণবাদী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে বরং এর ব্যাপক প্রসারে ভূমিকা রাখার বিষয়ে প্রচারণা চালাতে হবে।

চার. শোভনকর্ম এবং উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করার জন্য এ জোটের বিষয়ে আইএলও’র নিজস্ব অংশীজনদের ব্যাপক সমর্থন নিশ্চিত করতে হবে।

পাঁচ. তরুণ সমাজকে সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রবক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই জোটকে মনোযোগী হতে হবে। একমাত্র সামাজিক ন্যায়বিচারই স্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি রচনা করতে পারে। বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রয়াসে সামাজিক ন্যায়বিচারকে আমাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।