ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

লোডশেডিং নিরসনে আসছে সুখবর

ভোলায় গ্যাস সরবরাহ : আমদানি হচ্ছে কয়লা
লোডশেডিং নিরসনে আসছে সুখবর

ডলার সংকটের কারণে গরমের মৌসুমে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে চাপে পড়ে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে নিয়মিত লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে মানুষ। তবে চলমান লোডশেডিং পরিস্থিতি অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। মানুষের ভোগান্তি অনেককাংশে কমেছে। লোডশেডিং পরিস্থিতি এড়িয়ে কীভাবে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আনা যায় তা নিয়ে বেশকিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা কমেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই গ্যাস ও কয়লা আমদানি পর্যাপ্ত হবে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে হঠাৎ করেই অতিরিক্ত গরমে এসি ও ফ্যান স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে মাঠ পর্যায়ে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে হয় বিদ্যুৎ বিভাগকে। জ্বালানির চাহিদা মেটাতে ভোলার গ্যাস ক্ষেত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে। মজুত ২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে এই অঞ্চলের ৯ কূপ থেকে দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও পাইপলাইনের সংকটে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস যোগ করা যায়নি। সম্প্রতি এই প্রাকৃতিক গ্যাসকে সিএনজিতে (কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস) রূপান্তর করে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভোলার গ্যাসক্ষেত্র ছাড়াও লোডশেডিংয়ের চাপ সামলিয়ে বিভিন্নভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎেেকন্দ্রর পাশাপাশি সব সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সোলার প্যানেল বসানোর পরিকল্পনা চলছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব পড়েছে। সেজন্য বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী লাইট এলইডি ব্যবহার করার জন্য ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভোক্তাদের জন্য জ্বালানি নিরীক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আধুনিক ইটভাটায় পরিবর্তন ও গ্যাসচালিত সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে কম্বাইন সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে রূপান্তরের জন্য সরকার বাস্তবমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে নতুন ভবন বিধিতে জ্বালানি কার্যকারিতা এবং সৌর জ্বালানির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে ভবন বিধি সংশোধন করা হবে। রাইস পার-বয়লিং সিস্টেম থেকে দক্ষ রাইস পার-বয়লিং সিস্টেমে পরিবর্তন করা হচ্ছে। জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ও গ্যাস আমদানিতে ডলারের জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল। সেই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে জ্বালানির ঘাটতি মেটানোসহ জ্বালানি সংরক্ষণের জন্য জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি শুরু বিষয়ে আলোচনা হয়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার কমানো কিংবা তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং তার উপরে রাখার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। আমদানিকৃত/দেশে তৈরি ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যের এনার্জি স্টার লেবেলিং কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য মতে, গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৩৯৩ কোটি ৩০ লাখ ইউনিট। চলতি অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৯৪ কোটি ৮০ লাখ ইউনিট। এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে পিডিবি। অন্যদিকে আগামী অর্থবছর বিদ্যুতের সম্ভাব্য উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ২০ লাখ ইউনিট। এর মধ্যে গ্যাস থেকে উৎপাদনের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর ফার্নেস থেকে ২.৫৪ শতাংশ, কয়লা থেকে ২৩.৫৮ শতাংশ ও ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলোয় শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা হবে (আদানিসহ) ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এতে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বাড়লেও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমবে।

বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের ২০২১-২০২২ বার্ষিক প্রতিবেদন তথ্যে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো বেশকিছু গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এছাড়া বিদেশি দাতা সংস্থার সহায়তায় যৌথ বিনিয়োগেও নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়েছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এগোতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। কারণ, আগামীতে আর সস্তায় জ্বালানি কেনা সম্ভব হবে না। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে পিডিবি’র মালিকানায় ১ হাজার ৫৭৫ মেগাওয়াট এবং বিপিডিবি ও মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি জিইর (জেনারেল ইলেকট্রিক) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সাল থেকে শুরু করে ২০২৮ সাল নাগাদ উৎপাদনে আসবে।

পিডিবির গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে হরিপুরে ২৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট, নরসিংদীর ঘোড়াশালে একই প্রযুক্তির ২২৫ মেগাওয়াট, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ৫৫০ মেগাওয়াট, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ৫৫০ মেগাওয়াট। পিডিবির উদ্যোগে পরিকল্পনাধীন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। গ্যাসভিত্তিক সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে নির্মাণ হচ্ছে। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে এরই মধ্যে মার্কিন কোম্পানি জিইর সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে সংস্থাটি। আগামী ২০২৭ ও ২০২৮ সালকে সম্ভাব্য উৎপাদন বছর ধরে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছে বিপিডিবি। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (সিপিজিসিএল) সঙ্গে জাপানের মিৎসুই অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড ৫৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।

বিদ্যুতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যু সরবরাহে বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ইতোমধ্যে কয়লাভিত্তিক কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। আগামীতে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক আরো কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। এখানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে অন্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো চ্যালেঞ্জিং। অন্য জ্বালানির তুলনায় গ্যাসই সহজলভ্য এবং তুলনামূলক সাশ্রয়ী। গ্যাস সংকট রয়েছে। তবে বিদ্যুৎ চাহিদা বিবেচনায় জ্বালানি আমদানি করেই আমাদের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলেছে, প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট, এর বিপরীতে সরবরাহ ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই হিসেবে দৈনিক গ্যাসের ঘাটতি ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের অভাবে শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে গত বছরের শেষ থেকে লোডশেডিং করে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়।

জ্বালানি বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি পরিস্থিতিতে দেশে বিদ্যুৎসহ শিল্প কারখানায় গ্যাসের সংকট নিরসনে ভোলা অঞ্চলের উদ্বৃত্ত গ্যাসে সর্বোত্তম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (এসজিসিএল)-এর তত্ত্বাবধানে ইন্ট্রাকো রিফুয়েলিং স্টেশন লিমিটেডের মাধ্যমে গ্যাস কম্প্রেসড করে নিয়ে এসে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) এর আওতাধীন এলাকার শিল্প প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের সরবরাহ করা হবে। এক্ষেত্রে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য হবে ৪৭.৬০ টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের চার্জ ৩০.৫০ টাকা, ফিড গ্যাসের মূল্য ১৭ টাকা এবং ডিমান্ড চার্জ ০.১০ টাকা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ভোলার গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দ্বীপ জেলা ভোলায় কয়টি গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব গ্যাসক্ষেত্রে দৈনিক প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনে সক্ষমতা। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পরেও ৭০ থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অব্যবহৃত থেকে যায়। তবে পাইপলাইন না থাকায় জাতীয় গ্রিডে যোগ করা সম্ভব হয়নি। এখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন এই গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করতে। তাই আমরা চেষ্টা করছি। এখন ২৫ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস আসবে না। তবে আমরা পাইপলাইন তৈরির কাজ শুরু করব শিগগিরই। এটি হলে ভোলা থেকে উৎপাদিত সব গ্যাসই জাতীয় গ্রিডে আসবে।

বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা জ্বালানি অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ভোলা থেকে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়া নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র এবার কাজে লাগবে, দেরিতে হলেও সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে। এভাবে একে একে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের অনুসন্ধান বাড়বে বলে মনে করি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত