যোগ্যতা না থাকলেও তিনি পবিপ্রবি’র শিক্ষক

প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  পটুয়াখালী প্রতিনিধি

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর মো. মেহেদী হাসান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে রীতি মতো ব্লাকমেইল শিক্ষক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। তার নিজেই যোগ্যতা না থাকলেও অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পেয়েছেন অবৈধভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের যে যোগ্যতা নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল সে অনুযায়ী মেহেদী হাসানের সিজিপিএ অনেক কম। তবে সাম্প্রতিক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও রেজিস্ট্রারসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের ছবি এবং নাম দিয়ে তাদের গলায় ফাঁসির প্রতীকী রশি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়ে রীতিমতো আলোচনায় এসেছেন এই শিক্ষক। অবশ্য এ কারণে অভিযুক্ত শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বিবিদ্যালয়ে প্রভাষক (নন টেকনিক্যাল) পদে চাকরি পান মেহেদী হাসান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় এতে প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে যে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংশ্লিষ্ট অনুষদে স্নাতক ডিগ্রির অধিকারী হতে হবে। শিক্ষা জীবনে সব স্তরে প্রথম বিভাগ/শ্রেণি থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রার্থির জিপিএ/সিজিপিএ-৪ এর জন্য কমপক্ষে ৩.৭৫ হতে হবে। তবে শিক্ষক মেহেদী হাসানের সিজিপিএ-২.৯৫। এর পরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষকদের তিনি ব্লাকমেইলিং করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও রেজিস্ট্রারসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষকের ছবি ব্যবহার করে তিনি তাদের ফাঁসির দাবি তুলে পোস্টার ছাপিয়েছেন। যাতে দাবি করা হয় ‘২০১৮ সালের ১৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী দেবাশিষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পাওয়ায় আত্মহত্যা করেছেন। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসির দাবি করে তিনজন শিক্ষকের ছবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি ও রেজিস্ট্রারের ছবি ব্যবহার করে পোস্টার ছাপানো হয়। পোস্টারে হত্যাকারীদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা বর্তমান ভিসি ও রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ দাবি করা হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, মূলত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে চাপে ফেলতেই গোপনে এমন একটি পোস্টার ছাপিয়ে তা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগানোর পরিকল্পনা করছিলেন প্রফেসর মেহেদী হাসান। এজন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. মুকিতকে আগে থেকেই বলেছিলেন- তার (মেহেদী হাসান) কিছু পোস্টার আসবে সেগুলো যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে তিনি লাগিয়ে দেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. মুকিত বলেন, ‘সেদিন রাতে আমাকে মেহেদী স্যার বলেছিলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িতে একটি প্যাকেট আসবে আপনি উপজেলার গেট থেকে প্যাকেটটি নামিয়ে নেবেন। আমি ব্যস্ত থাকায় আমার এক নিরাপত্তা কর্মীকে দিয়ে প্যাকেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে নামিয়ে রাখি। সকালে যখন প্যাকেটটি খুলি তখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়রে ভিসি স্যার এবং রেজিস্ট্রার স্যারের ছবি দিয়ে পাশাপাশি তিনজন শিক্ষকের ছবিতে ফাঁসির রশি দিয়ে পোস্টার করা হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে, এমন একটি পোস্টার লাগাতে পারি না। তাৎক্ষণিক আমি রেজিস্ট্রার স্যারকে জানাই। রেজিস্ট্রার স্যার পোস্টার দেখার পর জানতে চাইলে আমি তাকে পুরো বিষয়টি বলি। এ সময় যে নিরাপত্তকর্মী পোস্টার গাড়ি থেকে নামিয়েছেন, গাড়ির চালক এবং বরিশালের যে প্রেস থেকে পোস্টার ছাপানো হয়েছে সবার সাথেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কথা বলেছে এবং বিষয়টি তখন প্রমাণ হয় যে, মেহেদী স্যার পোস্টারগুলো আনিয়েছেন। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে যখন দেবাশীষ আত্মহত্যা করে ওই সময় আমি কোনো দায়িত্বে ছিলাম না এবং আমি দেশের বাহিরে অবস্থান করছিলাম। কি কারণে আমার ছবি ব্যবহার করে পোস্টার ছাপানো হয়েছে, তা হয়তো (মেহেদী হাসান) সে বলতে পারবেন। এছাড়া প্রফেসর মেহেদী হাসান যে পোস্টারগুলো ছাপিয়েছেন, তা নিয়ে আসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রাইভারকে নির্দেশনা দেন এবং পোস্টার নামানো ও লাগানোর জন্য নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়েছেন- এ বিষয়গুলো প্রাথমিক ভাবে প্রমাণিত। এ কারণে গত ২৮ মে ভিসি স্যারের নির্দেশ মোতাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রফেসর মো. মেহেদী হাসানকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ১২(১) এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী সাধারণ আচরণ ও শৃঙ্খলা বিধিমালা ৯(১) মোতাবেক চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।’ এদিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে মেহেদী হাসান এর যোগ্যতা না থাকলেও নিয়োগ পাওয়ার বিষয় জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন, ‘তাকে যখন নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তখন যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। তবে এ বিষয় অভিযোগ পেলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড.স্বদেশ চন্দ্র সামন্ত বলেন, ‘দেবাশীষ আত্মহত্যার বিষয় কারো কোন অভিযোগ নেই। আমি সে সময় (২০১৮ সালে) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্বে ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের সাথে রেজিস্ট্রার কোনো ভাবেই জড়িত থাকে না।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযুক্ত শিক্ষক (সাময়িক বরাখাস্ত) প্রফেসর মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি পোস্টার ছাপানোর সাথে জড়িত নই। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে সাময়িক বরখাস্তের যে চিঠি দিয়েছে, তাতে পোস্টার ছাপানোর বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার জন্য বিজ্ঞপ্তিতে যে সিজিপিএ’র মানদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তার থেকে মেহেদী হাসানের সিজিপিএ অনেক কম হলেও তিনি কীভাবে নিয়োগ পেয়েছেন- এমন প্রশ্নে মেহেদী হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রাশাসন আমাকে যোগ্য মনে করেছে বিধায় নিয়োগ দিয়েছে। এ বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবে।’