ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হাই প্রোফাইল ‘জল্লাদ’ শাহজাহানের মুক্তি

৩২ বছরে ২৬ জনের ফাঁসির দড়িতে টান
হাই প্রোফাইল ‘জল্লাদ’ শাহজাহানের মুক্তি

জল্লাদ শাহজাহান। নামটি দেশের ওয়াকিবহাল মহলে বেশ পরিচিত। দেশের আলোচিত এবং বড় বড় ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসি কার্যকরে প্রধান জল্লাদের ভূমিকা পালনের মাধ্যমে তিনি আলোচনায় আসেন। ৪২ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে কারাবাসে যাওয়া শাহজাহান ২০০১ সাল জল্লাদের খাতায় নাম লিখিয়ে ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টেনেছেন। কারাগারের তথ্যানুযায়ী, শাহজাহান এ পর্যন্ত ২৬ জনের ফাঁসির দড়ি টেনেছেন, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন ছয়জন। এছাড়া চারজন যুদ্ধাপরাধী, দুজন জেএমবি সদস্য ও অন্যান্য আলোচিত মামলার ১৪ আসামি। বিনিময়ে সাজার মেয়াদ ১০ বছর মওকুফ (রেয়াত) পেয়ে মুক্ত জীবনে ফিরলেন গতকাল। দীর্ঘ ৩২ বছর কারাভোগের পর গতকাল বেলা ১১টা ৪৭ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ ছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, শাহজাহান ভূঁইয়া ১৯৯১ সালে গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দিজীবন কাটানোর পর এখন তিনি মুক্ত। এর আগে গত শনিবার রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে (কেরানীগঞ্জ) সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ জল্লাদ শাহজাহানের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

এরশাদ শিকদার, বাংলাভাইসহ ২৬ জনের ফাঁসি দেন জল্লাদ শাহজাহান দেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় কারাগারে বন্দি থাকা জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে সব থেকে বেশি (২৬টি) ফাঁসি দেয়ার রেকর্ড তার। জানা যায়, শাহজাহান ভূঁইয়া একমাত্র জল্লাদ, যিনি এক রাতে দুই কারাগারে চার আসামিকে ফাঁসি দিয়েছেন। তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় জগতে জল্লাদদের আইডল ধরা হয়।

জল্লাদ শাহজাহানের পরিচয় : জানা গেছে, জল্লাদ শাহজাহানের পুরো নাম শাহজাহান ভূঁইয়া। তিনি নরসিংদী জেলার পলাশ থানার ইছাখালী গ্রামের মৃত হাছেন আলীর ছেলে। জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চে। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তার তিন বোন ও এক ভাই। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। খাস হাওলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন পারলিয়া উচ্ছ বিদ্যালয়ে। এরপর ১৯৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ৭৩ বছর বয়সি শাহজাহান ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত। কারাগারে তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ ।

সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিন বছর : ছোট থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড তাকে খুব আকর্ষণ করত। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার সব থেকে বেশি ভালো লাগত। তাই মনেপ্রাণে সবসময় চাইতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার কাছে একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে তিনি টিকে যান। পরে ৩ বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বাড়ি চলে আসেন। চাকরি করবেন না বলে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। ফলে সেনাবাহিনী থেকে চাকরি হারান।

নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ : মুক্তিযুদ্ধের ৪ বছর পরের কথা, তখন তিনি তরতাজা তরুণ। এইচএসসি পাস করেছেন ২ বছর আগে। মনের অজান্তে ভালো লেগে যায় কমিউনিস্ট পার্টি, যোগ দেন দলে। তার কার্যক্রমে খুশি হয়ে কেন্দ্র থেকে ডেকে পাঠানো হয়। ওই সময় নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব নেন।

অপরাধ জগতে প্রবেশের ইতিবৃত্ত : মানুষ হিসেবে শাহজাহানের বেশ সুনাম ছিলেন। পারতপক্ষে কারো উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না তিনি। তবে প্রচণ্ড বন্ধু পাগল ছিলেন। একবার গ্রামে দুই বন্ধুসহ শাহজাহানের নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে বসা সালিশ কার্যক্রমে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে সাজা দেয়া হয়। এরপর থেকেই বদলে যান। ওই দিনের অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করার। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ।

যেভাবে আটক হন : গ্রামের ওই ঘটনার পর জল্লাদ শাহজাহান তখন বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন। এছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের পর থেকে যেকোনো অপারেশনে (দলীয় গোপন কার্যক্রমে) তার চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়, এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে কাজ শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। তবে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফিরছে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে তা জানতে পারেন। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন, ওই সময় তাকে আটক করে পুলিশ। এরপর থেকে তার বন্দিজীবন শুরু।

জল্লাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ : জীবনের সোনালি সময় তাকে কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে চিন্তা করলেন জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে সাজা কিছুটা হলেও কমবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। প্রথমে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদ মনোনীত করে।

প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয়জন সহযোগী থাকেন। এছাড়া একটি ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। শুধু ফাঁসির রায় কার্যকর নয়, কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করতেন, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন।

৩৬ মামলায় ১৪৩ বছরের জেল : ১৯৯১ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা। বিচারকার্যে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ৪ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছর। পরে ৮৭ বছর সাজা মওকুফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়া হয়।

শাহজাহানের জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ তার জেল কার্ডের ওপর লেখা ছিল ‘ডেট অব রিলিজ ২০৩৫’। তবে ফাঁসি কার্যকর, সশ্রম কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে এখন তার ‘ডেট অব রিলিজ’ চলতি বছরের ১৮ জুন। ফলে তার মুক্তি মিলেছে।

গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া : কারাগার থেকে বের হয়ে ফাঁসির সময় আসামিরা কে কেমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এসব বিষয়ে কথা বলেন তিনি। ২৬ জনের ফাঁসি দিয়েছেন জল্লাদ শাহজাহান। এমনি কী হয়েছিল ফাঁসির আগে, আসামিকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ফাঁসিতে কিছু না কিছু আবেগ থাকে। মানুষ যত অপরাধীই হোক না কেন, সে যখন মৃত্যুর মুখে তখন সবারই মায়া লাগে। আমি না হয় মায়া করলাম, কিন্তু আদালত কিংবা আইনতো ক্ষমা করবে না। তাই মায়া লাগলেও আইনের আদেশ পালন করতে গিয়ে ফাঁসি তো দিতেই হবে। কারাগার থেকে বের হয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান জল্লাদ শাহজাহান। কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার ও শীর্ষ জঙ্গিনেতা বাংলাভাইয়ের ফাঁসির আগমুহূর্তে তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরশাদ শিকদারকে যখন ফাঁসি দেয়া হয় এর আগে তিনি দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- ‘আমি জীবনে কোনো অন্যায় করেনি, আমার জন্য দোয়া করবেন।’ আর বাংলাভাই ফাঁসির আগে তেমন কিছু বলেননি। তবে তিনি ফাঁসির আগে বলেছিলেন ‘আমার মৃত্যুর পর যেন আমার ছবি তোলা না হয়।’

ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কী বলেছিলেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ফাঁসির আগে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কোনো কথা বলেননি। যুদ্ধাপরাধীরাও ফাঁসির আগে কোনো কথা বলেননি। ফাঁসির আগে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল জানতে চাইলে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ‘একটা মানুষ যতই উচ্ছৃঙ্খল থাকুক না কেন, যখন তিনি জেনেছেন মারা যাবেন, তখন তিনি আর কোনো কথা বলেন না, চুপচাপই থাকেন। তিনি কারাগারে থাকার সময় উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছে বলে জেনেছি। তবে ফাঁসির দিন তিনি কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেননি। তিনি জানতেন এখানে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে কোনো লাভ নেই। আমাকে চলে যেতে হবে, তাই তিনি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেননি, সুন্দরমতো চলে গেছেন।’ ফাঁসির সময় সাকা চৌধুরীর মাথা আলাদা হয়ে গিয়েছিল কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘না না এটা হয়নি। এটা কখনো হয় না। কারো মাথাই আলাদা হয় না ফাঁসির সময়, এগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া কথা। আসামির উচ্চতা ও ওজন অনুযায়ী ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়। এজন্য ফাঁসির সময় কারো মাথাই আলাদা হয় না।’ শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মুনির ফাঁসির আগে কী বলেছিলেন- প্রশ্ন করা হলে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, ‘মুনির ফাঁসির আগে বলেছিলেন, আমাকে একটা সিগারেট দেন আমি খাব।’ মুক্তি পেয়ে তিনি বলেন, আমি অপরাধ করেছি, সেজন্য জেলে সাজা ভোগ করেছি। এখন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার মতো। আমি অতীতের সবকিছু ভুলে গেছি। এখন আমি আগামী দিনে কীভাবে চলব, থাকব সেটা হচ্ছে বিষয়। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমার বাড়ি, ঘর নেই। এত বছর জেল খাটার পর আমার কিছুই নেই। আমি এখন কারাগার থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতেও যাচ্ছি না। আমি আরেকজনের বাড়িতে গিয়ে উঠছি এখন। আমি এখন কী করে খাব? কোথায় যাব? কী করব? আমার এখন আর কিছু করার বয়স নেই। জল্লাদ শাহজাহান আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার একটিই আবেদন, আমাকে যেন বাড়িঘর ও একটি কর্মসংস্থান দিয়ে চলার মতো কিছু করে দেন। এটিই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত