ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ওলামা লীগের শীর্ষ পদে ‘দুধের মাছি’

ওলামা লীগের শীর্ষ পদে ‘দুধের মাছি’

বাংলাদেশ আওয়ামী ওলামা লীগ। বরাবরই সমালোচনা জন্ম দিয়েই আলোচনা এসেছে। ব্যতিক্রম ঘটেনি স্বীকৃতি দেয়া পরও। একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। এবার বির্তক সংগঠনের কমিটি নিয়ে। নবাগতারা ওলামা লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হলেও বাদ পড়েছেন এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রাখা নেতাকর্মীরা। তাদের কেউ পায়নি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষপদ। নবাগতরা শীর্ষপদ পাওয়ায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সংগঠনে। বিরোধী দলে থাকাকালীন আওয়ামী লীগের জন্য যারা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছেন, নতুন কমিটিতে তাদের মূল্যায়ন হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।

জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে নবরূপে প্রতিষ্ঠিত ওলামা লীগের প্রথম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় গত ২০ মে। সম্মেলন হলেও তৎক্ষণাৎ কমিটি গঠন করা হয়নি। গেল ১৫ জুন রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওলামা লীগের কমিটির কয়েকটি কাগজ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বিভিন্ন পদে ২৮ জনের নাম দেখা যায়। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা কেএম আবদুল মমিন সিরাজীকে সভাপতি, মাওলানা সাগর আহমেদ শাহীনকে কার্যকরী সভাপতি ও আমিনুল হককে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর পরই কানাঘুষা শুরু হয় র্দীঘদিন ধরে ওলামা লীগ করে আসা নেতাকর্মীদের মধ্যে। ঘোষিত কমিটি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তারা। বর্তমান কমিটির পদ পওয়া ১৬ জন সঙ্গে সঙ্গে তাদের পদ প্রত্যাখ্যান করেন। কমিটির কোথায়ও রাখা হয়নি এক-এগারোর সময় ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা মাওলানা ক্বারি আসাদুজ্জামান আসাদকে। তিনি ওলামা লীগের মরহুম সভাপতি ইলিয়াস বিন হেলালীর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আসাদ বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা আমাকে ওলামা লীগের কোনো পদে রাখেনি। আমি নেত্রীর (শেখ হাসিনা) মুক্তি আন্দোলনসহ ২০০১ সাল থেকে ওলামা লীগের রাজনীতি করি। বর্তমান কমিটিতে প্রকৃত ওলামা লীগের নেতাকর্মীরা শীর্ষ কোনো পদ পাননি। হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারীরা ওলামা লীগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

ওলামা লীগের আকতার হোসেন বোখারি ও কাজী মাওলানা আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরীকে দেয়া হয় সান্ত্বনা পদ উপদেষ্টার। শরীয়তপুরী দলের দুঃসময়ে ওলামা লীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলেয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। উপদেষ্টার পদে সন্তুষ্ট নন বলে আলোকিত বাংলাদেশকে জানিয়েছেন কাজী মাওলানা আবুল হাসান শেখ শরীয়তপুরী। তিনি বলেন, ওলামা লীগের উপদেষ্টার পদে আমি সস্তুষ্ট না। আমাকে সভাপতি না বানালেও সিনিয়র সহ-সভাপতি বানাতে পারত। রাজপথে আমার ত্যাগ রয়েছে। দলের দুঃসময়ে ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি আওয়ামী লীগের জন্য ভূমিকা রেখেছি। অনেক হামলা-মামলার শিকার হয়েছি। আমাকে কোণঠাসা করে রাখতে উপদেষ্টার পদ দেয়া হয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, সংগঠনে আমাদের প্রয়োজন না থাকলে আমাদের বাদ দিয়ে দিত। এছাড়া ২০০১ সাল থেকে যারা রাজপথে ছিল তাদের এ কমিটিতে রাখা হয়নি। যারা ওলামা লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন দলের দুঃসময়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওলামা লীগ আলেমদের সংগঠন। এখানে লেখাপড়া না জানা লোকজনকে কমিটির শীর্ষপদ দেয়া হয়েছে। নারী কেলেংকারী, চাঁদাবাজির মতো অভিযোগ রয়েছে শীর্ষপদ পাওয়াদের বিরুদ্ধে। আরো যাচাই-বাছাই করে ওলামা লীগের কমিটি গঠন করার দরকার ছিল।

জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক আলেমদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আসার চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন ধর্ম সম্পাদক মরহুম শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। এদিকে ওলামা লীগের নেতারাও আওয়ামী লীগের দাপ্তরিক স্বীকৃতির জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে থাকেন। ২০১৯ সালে ওলামা লীগের সব পক্ষের সম্মতিতে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি করে দেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ। তিনি তখন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। এক বছর পরই সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি থেকে বের হয়ে যায় ওলামা লীগের একটি অংশ। নিজেদের মধ্যে ঐক্য না থাকায় ফের গত বছরের ১২ অক্টোবর ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওলামা লীগের সব পক্ষকে নিয়ে বিশেষ বর্ধিত সভাও করেন ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ। তখনই বর্তমান কমিটির সভাপতি ড. আব্দুল মমিন সিরাজীর ওলামা লীগে অভিষেক ঘটে। এর আগে তিনি কখনো ওলামা লীগ করেছেন বলে শোনা যায়নি। ওলামা লীগের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক না হওয়ার শর্তে রেজুলেশনে স্বাক্ষর করে সংগঠনের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হন ড. আব্দুল মমিন সিরাজী। সম্মেলন করেই সংগঠন থেকে বিদায় নেয়ার কথা ছিল তার। আর সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক কখনো ওলামা লীগ করেননি। আওয়ামী লীগের স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে শুনেই চকবাজারের ব্যবসায়ী আমিনুল হক ভিড় করতে থাকেন ওলামা লীগের নেতাদের চারপাশে। কৌশলে তিনি ওলামা লীগের পদ বাগিয়ে নেন। এরই মধ্যে ওলামা লীগের সদ্য নির্বাচিত কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল হকের আপত্তিকর একটি ভিডিও ফাঁস হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি হোটেল কক্ষে গানের তালে এক নারীর নৃত্য উপভোগ করছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য অ্যাপে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দল ও দলের বাইরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। জানতে চাইলে আমিনুল হক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ওলামা লীগের কমিটির বিষয়ে কথা বলার দায়িত্ব আপনাদের নয়। আর মানুষের দোষ নিয়ে আপনি যত ঘাটাঘাটি করবেন আল্লাহ আপনার দোষ প্রকাশ করে দেবেন। এগুলো কোনো আলোচনার বিষয় নয়। কমিটি ফাইনাল হয়ে গেছে। পেছনের কথা বাদ দেন।

কমিটির বিষয়ে বর্তমান সভাপতি ড. আব্দুল মমিন সিরাজীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক আলেম হতে হবে এটা শর্ত নয়। আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে হাফেজ, ক্বারি, মাওলানা ও ধর্মভীরু মানুষ ওলামা লীগ করতে পারবে। ওলামা লীগের যে কমিটি হয়েছে, তা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুমতি নিয়েই হয়েছে। সুতরাং, এ নিয়ে যারা বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদকে আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এটা দুঃখজনক বিষয়।

ওলামা লীগে নবাগত ড. আব্দুল মমিন সিরাজী নিজেই কৌশলে তা আলোকিত বাংলাদেশের কাছে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ওলামা লীগের কেউ সম্মেলন করানোর যোগ্যতা রাখে না। আমি ওলামা লীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হব না বলে মুসলেকা দিয়ে সম্মেলন করানোর জন্য আহ্বায়ক হয়েছিলাম। ওলামা লীগের নেতাদের উচিত ছিল আপনি (ড. আব্দুল মমিন সিরাজী) সভাপতি হন এ কথা বলা। কিন্তু কেউ এই কথা বলেনি। সম্মেলনে ১৬ জন আমাকে সভাপতি হিসেবে সমর্থন দিলেও তিনজন সমর্থন দেননি। তারাই আজকে কমিটি নিয়ে বিতর্ক ছড়াচ্ছেন।

২৮ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির সহ-সভাপতির পদ প্রত্যাখ্যান করেছেন মুফতি মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী। তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ওলামা লীগ না করা ব্যক্তি, বিএনপি-জামায়ত থেকে আগত অনুপ্রবেশকারীরা সংগঠনের শীর্ষপদ বাগিয়ে নিয়েছে। ওলামা লীগ এখন ‘দুধের মাছি’দের দখলে। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের ওলামা লীগের ব্যানারের যাদের ন্যূনতম অবদান নেই, তাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল- আওয়ামী লীগের দলীয় স্বীকৃতির মধ্যদিয়ে ওলামা লীগ এগিয়ে যাবে, আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। তবে পরিতাপের বিষয়, ওলামা লীগের দুঃসময়ে কোনো নেতাকর্মী শীর্ষপদ পাননি। রাতের আঁধারে ওলামা লীগের কমিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে একটি কূটকৌশল বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতো শীর্ষপদ পাওয়া ব্যক্তিদের অতীত রাজনীতি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়া আমিনুল হকের একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তিনি কোনো আলেম নন। তার এই ভিডিও ইসলামি অঙ্গনে আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করবে। এই কমিটি বাতিল করে ওলামা লীগের ত্যাগী নেতাদের মধ্য থেকে কমিটি করার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

ওলামা লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক হাফেজ মাওলানা সুলাইমান বলেন, আব্দুল মমিন সিরাজীকে আমি নিয়ে এসেছিলাম ওলামা লীগের সম্মেলন করার জন্য। তবে শর্ত ছিল, তিনি কখনই ওলামা লীগের শীর্ষপদ সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক হতে পারবেন না। এই বিষয়টি আমাদের রেজুলেশনেও রয়েছে। সেখানে তিনি স্বাক্ষরও করেছেন। ওলামা লীগের বিভাগীয় সম্মেলনেরও আলেম-ওলামাদের সামনেও সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক হবেন না- মর্মে ওয়াদা করেছিলেন। এজন্য তাকে আমরা ওলামা লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক বানিয়েছিলাম। তিনি তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আব্দুল মমিন সিরাজীর অতীতে জামায়ত-শিবিরের রাজনীতির করেছেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। আওয়ামী লীগের নেতাদের চোখে ধুলো দিয়ে পদ বাগিয়ে নিয়েছেন সিরাজী। আর সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক ওলামা লীগের কেউ নয়। তিনি আলেম বা শিক্ষিত নয়। একজন ব্যবসায়ী। তার একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ওলামা লীগের মতো সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের নৈতিক চরিত্র নিয়েও আলেম সমাজে প্রশ্ন উঠেছে। রাতের আঁধারে ফেসবুকে প্রকাশিত কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে ওলামা লীগ নিরাপদ নয়। এই কমিটি দ্রুত বাতিল করে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে রাজপথে নির্যাতিত নেতাকর্মীরা দিয়েই কমিটি করার দাবি জানাচ্ছি।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত