ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গভীর সাগরে পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প

পরীক্ষামূলক জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু হচ্ছে আজ

* বছরে বিপিসির সাশ্রয় হবে ৮০০ কোটি টাকা * তেল খালাস শেষ করতে ৯ দিনের স্থলে লাগবে ৪ দিন
পরীক্ষামূলক জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু হচ্ছে আজ

বহু প্রতীক্ষার পর অবশেষে গভীর সাগর থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরীক্ষামূলক পরিবহন আজ থেকে শুরু হচ্ছে। সৌদি আরব থেকে শনিবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এলাকার কাছে গভীর সাগরে ভিড়েছে বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কার। আজ সেই ট্যাঙ্কারে থাকা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস করা হবে পাইপলাইনের মাধ্যমে। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহনে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। এসব জ্বালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি যাবে চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা এলাকায় অবস্থিত ইআরএলের স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। সরাসরি তেল খালাসে সময় লাগবে কম। অপারেশন লস বাবদ শত কোটি টাকার জ্বালানি তেল নষ্ট কিংবা চুরির আর কোনো সুযোগ থাকবে না বলে জানান কর্মকর্তারা। তবে প্রকল্প কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। পুরোদমে জ্বালানি তেল শুরু হবে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে। ইআরএল সূত্র জানায়, ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নির্মাণ শেষ হয়েছে কিছু দিন আগে। আজ সৌদি আরব থেকে আসা অয়েল ট্যাঙ্কারের ক্রুড মুরিং পয়েন্টে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ শুরু হবে। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের মাধ্যমে তেল সরবরাহ করে জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। ইআরএলের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করতে আমরা প্রস্তুত। সৌদি আরব থেকে ৮২ হাজার টন ক্রুডবাহী একটি বড় অয়েল ট্যাঙ্কার মহেশখালীতে মুরিং পয়েন্টে এসেছে। আজ পরীক্ষামূলক পরিবহন বা কমিশনিং শুরু করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রকল্প কাজ পুরোপুরি শেষ হলে এরপর ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু করা হবে। জুলাই অথবা আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। বিপিসি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা পরিশোধিত (রিফাইন) ও ক্রুড (অপরিশোধিত) জ্বালানি তেল পরিবহনে নানা সমস্যা ছিল দীর্ঘদিন। এই সমস্যা থেকে উত্তরণে দ্রুত তেল খালাসে গভীর সাগরে পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। চলতি মাস থেকে বন্দরের বহির্নোঙর থেকে অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কারে করে পরিবহন ও খালাসের পুরনো পদ্ধতি পুরোপুরি বদলে ফেলার প্রস্তুতি নেয়া হয়। সমুদ্রের তলদেশে স্থাপন করা পাইপলাইন সরাসরি যুক্ত হচ্ছে পতেঙ্গায় অবস্থিত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। দিনে গড়ে ৫০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল খালাস হবে এ পাইপলাইনের মাধ্যমে। আমদানি করা জ্বালানি তেল খালাসে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) দুইটি লাইটার ট্যাঙ্কার আর দরকার হবে না। বিপিসির কাছে এমটি বাংলার সৌরভ আর এমটি বাংলার জ্যোতির প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে। এভাবে অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে পাইপলাইনে সরাসরি জ্বালানি তেল স্টোরেজ ট্যাংকে খালাসের কারণে বছরে বিপিসির সাশ্রয় হবে অন্তত ৮০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমদানি করা জ্বালানি তেলবাহী অয়েল ট্যাঙ্কার চট্টগ্রামবন্দরের বহির্নোঙরে নোঙর করত। সেখান থেকে লাইটার ট্যাঙ্কারে করে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গায় অবস্থিত ডলফিন অয়েল জেটিতে। সেখানে রজ ট্যাঙ্কার থেকে স্টোরেজ ট্যাংকে জ্বালানি তেল খালাস করা হতো। এতে নানা ধরনের সমস্যা হতো। বন্দর বহির্নোঙর থেকে স্টোরেজ ট্যাঙ্ক পর্যন্ত জ্বালানি তেল পরিবহন বাবদ বিপিসির বিপুল অর্থ ব্যয় হতো। পরিবহনের সময় নানা কারণে অপচয় হতো জ্বালানি তেল। চুরিও হয়ে যেত আমদানি করা জ্বালানি তেলের একটি অংশ। এতে বেড়ে যেত সিস্টেম লস। আর অয়েল লাইটারে করে খালাসের কারণে সময় ব্যয় হতো বেশি। তাতে বিদেশ থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে আসা বড় অয়েল ট্যাঙ্কার চট্টগ্রাম বন্দর ত্যাগ করতে দেরি হয়ে যেত।

দ্রুত জ্বালানি তেল খালাস, খালাসে সময় হ্রাস ও পরিবহন খাতে ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এটির কাজ শেষ। এবার গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত দুই ধরনের জ্বালানি তেল পরিবহন শুরুর প্রতীক্ষাও শেষের পথে। পরীক্ষামূলক শুরু হচ্ছে জ্বালানি তেল পরিবহন। বড় অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে খালাস হওয়া এসব জ্বালানি তেল আসবে পতেঙ্গায় অবস্থিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) স্টোরেজ ট্যাঙ্কে তেল খালাস হবে সরাসরি। দিনে গড়ে ৫০ হাজার টন জ্বালানি তেল খালাস হবে এই পাইপলাইনে। ৬ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে জ্বালানি তেল খালাসের জন্য পাইপলাইন স্থাপনের কাজ এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) মাধ্যমে তেল খালাস করে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হবে না। প্রকল্পটির নাম ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প। প্রকল্প পরিচালক ও ইস্টার্ন রিফাইনারির (ইআরএল) মহাব্যবস্থাপক মো. শরিফুল হাসনাত বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে শেষ হচ্ছে প্রকল্পের কাজ। এরপর থেকে পুরোদমে গভীর সাগর থেকে পতেঙ্গায় পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড রিফাইন দুই ধরনের জ্বালানি তেল পরিবহন শুরু হবে। সেইসঙ্গে প্রকল্পের সুফল ঘরে আসবে।

ইআরএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স অ্যান্ড প্ল্যানিং) রায়হান আহমেদ বলেন, ডলফিন অয়েল জেটিতে ভিড়ে লাইটার ট্যাঙ্কার থেকে জ্বালানি তেল খালাসের পুরো চিত্রই বদলে যাবে। এই জেটি আর আমদানি করা জ্বালানি তেল খালাসের জন্য দরকার হবে না। বড় অয়েল ট্যাঙ্কারে আমদানি করা জ্বালানি তেল গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি খালাস হবে স্টোরেজ ট্যাঙ্কে। এতে সময় ও অর্থ দুই ক্ষেত্রে সাশ্রয় হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণ প্রকল্প থেকে অনেক ধরনের সুফল মিলবে। প্রতি মাসে গড়ে বিপিসি ১ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড আমদানি করে থাকে। পাশাপাশি এক থেকে দেড় লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এসব ক্রুডবাহী বৃহদাকার মাদার অয়েল ট্যাঙ্কার নোঙর করে কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে। চট্টগ্রামবন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করতে পারে না। চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে নোঙর করতে পারে পরিশোধিত জ্বালানি তেলবাহী অয়েল ট্যাঙ্কার। মাদার ট্যাঙ্কারে করে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা হয় ক্রুড। বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, দেশে বর্তমানে গড়ে ৭০ লাখ টনের কাছাকাছি জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। এর মধ্যে ১২ লাখ মেট্রিক টন থেকে ১৫ লাখ মেট্রিক টনের মতো ক্রুড বা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়। বাকি আমদানি তেলের সবই পরিশোধিত অবস্থায় আনা হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা হয় এসব পরিশোধিত জ্বালানি তেল। অয়েল ট্যাঙ্কার কুতুবদিয়ার কাছে গভীর সাগরে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে এসব জ্বালানি তেল লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাঙ্কে নিয়ে আসা হয়। এই খাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি) বছরে গড়ে ৮০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। পাশাপাশি ১ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল লাইটারিং করতে গড়ে ১১ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। একেকটি মাদার অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে খালাস প্রক্রিয়া শেষ করতে লাগত ১২ থেকে ১৪ দিন। এ সময়ের জন্য জাহাজ মালিককে বিপুল ভাড়া পরিশোধ করতে হতো বিপিসিকে। এছাড়া মাদার অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে লাইটারেজ করার সময় জ্বালানি তেল অপচয়, নষ্ট হয়। বহু তেল চুরিও হয়। এভাবে বিপিসি প্রচুর সিস্টেম লসের কবলে পড়ে। এ ধরনের কঠিন সংকট কাটাতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলে ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হয়। পরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চীনের এক্সিম ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম ব্যুরো মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে ‘সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং’ নির্মাণ করবে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফশোর এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন। প্রকল্পে কাজ প্রায় শেষের পথে। কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকায় ৯০ একর জায়গার ওপর ছয়টি স্টোরেজ ট্যাঙ্ক ও পাম্প স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। ছয়টি স্টোরেজ ট্যাঙ্কের তিনটিতে পরিশোধিত এবং অপর তিনটিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুত করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কারের ধারণক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাঙ্কারের ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার। জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল ও পরিশোধিত তেল সরাসরি ভেসেল মুরিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখান থেকে পাম্প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে পুনরায় পাম্পের মাধ্যমে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হবে। ডাবল পাইপলাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল এবং অপর পাইপলাইন দিয়ে রিফাইনড অয়েল সরবরাহ দেয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় ১ লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করা যাবে।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত