পবিত্র হজ কাল

লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখর হবে আরাফাত ময়দান মিনায় তাঁবুতে অবস্থান হাজীদের

প্রকাশ : ২৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

এবারের পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা হবে আগামীকাল ৯ জিলহজ মঙ্গলবার। এদিন সৌদি আরবের ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে সমবেত হবেন লাখ লাখ হজপালনকারী মুসলিম। এর আগে মক্কার অদূরে মিনায় স্থাপিত তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে তাদের পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। গতকাল রোববার সকালেই মক্কা থেকে মিনায় যাওয়া শুরু করেন হজপালনকারীরা। সেখানে নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থান করে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছেন তারা। আজ জোহরের আগেও অনেকে মিনায় এসে পৌঁছাবেন।

করোনাভাইরাস মহামারির সময় ও পরবর্তী পরিস্থিতিতে সৌদি আরব কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত তিন বছর নানা শর্তে সীমিত পরিসরে পবিত্র হজ পালনের সুযোগ দেয়া হলেও এবার তা বড় আয়োজনে হবে। সৌদির পরিসংখ্যান অনুসারে, গত বছর ৯ লাখ ২৬ হাজারেরও বেশি লোক হজ পালন করেছেন। এর আগের বছর ২০২১ সালে প্রায় ৫৯ হাজার জন হজ পালন করেন। আর ২০২০ সালে শুধুমাত্র সৌদিতে অবস্থানরত ১০ হাজার মুসলিম হজের সুযোগ পেয়েছিলেন। অথচ করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালে প্রায় ২৫ লাখ লোক হজ পালন করেন। এবার কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ সম্পূর্ণভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে এবং বয়সের সীমা বাতিল করা হয়েছে। তাই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এবার ২০ লাখের বেশি মুসলিম পবিত্র হজ পালন করবেন বলে আশা করছে দেশটি। এরইমধ্যে প্রায় সব হজযাত্রী সৌদিতে পৌঁছেছেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অফিসের সর্বশেষ বুলেটিন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত ১ লাখ ২২ হাজার ৮৩৩ হজযাত্রী সৌদি আরব পৌঁছেছেন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১০ হাজার ৩২১ ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রী ১ লাখ ১২ হাজার ৫৬২ জন।

এদিকে পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে আগত মুসল্লিদের নিরাপত্তায় শুরু থেকেই নেয়া হয়েছে ব্যাপক ব্যবস্থা। সৌদি নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের লক্ষাধিক কর্মী দায়িত্ব পালনে রয়েছেন হজের নির্ধারিত স্থানগুলোতে।

তাঁবুর শহর মিনা সজ্জিত হয়েছে নতুনরূপে, আগের চেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছে মুসল্লিদের জন্য। মিনার বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েক হাজার অটো ইলেকট্রিক গাড়ি সেবা দেবে হাজিদের। এছাড়া আরাফাতের নির্ধারিত স্থানে সৌদি সেনা সদস্যদের কয়েক প্লাটুন মোতায়েন রয়েছে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায়।

এর আগে সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহবিষয়ক মন্ত্রী ডা. তৌফিক আল রাবিয়া বলেন, গতকাল রোববার থেকে বিশ্বের লাখো মুসলিমের লাব্বাইক ধ্বনিতে মুখরিত হবে মক্কা। এ বছর ৩২ হাজারের বেশি স্বাস্থ্যকর্মী হজযাত্রীদের সেবা দেবেন। হজ পালনে আল্লাহর অতিথিদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে সরকার ও সৌদির জনগণ অংশ নেবে।

অপরদিকে হজযাত্রীদের দিকনির্দেশনা দিতে এবারো বেশ কিছু রোবট মোতায়েন করেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। পবিত্র কাবাঘরের আঙিনায় কিং আব্দুল আজিজ কমপ্লেক্সের সামনেও দেখা গেছে এমনই একটি রোবট।

কিসওয়া (বিশেষ কালো কাপড় যা দিয়ে কাবাঘর আচ্ছাদিত করা হয়) গায়ে রোবটটি হজযাত্রীদের স্বাগত জানাচ্ছে। এছাড়া হজযাত্রীদের বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনাও দিচ্ছে।

গাল্ফ নিউজের এক প্রতিবেদন মতে, রোবটটি বিভিন্ন পণ্য নিয়ে আরবিতে দর্শনার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। এটি বিশ্বের ১১টি ভাষায় যোগাযোগ করতে পারে। ভাষাগুলো হলো: আরবি, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, রুশ, ফার্সি, তার্কিশ, চাইনিজ, বাংলা ও হাউসা ইত্যাদি। সূত্রমতে, আজ সোমবার সৌদি আরবে ৮ জিলহজ। এদিন থেকেই মূলত পবিত্র হজের ৫ দিনের টানা কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যা ১২ জিলহজ তথা শুক্রবার শেষ হবে।

এহছানুল হক নামে মক্কায় অবস্থানরত বাংলাদেশি একজন হজযাত্রী গতকাল বিকালে আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, দেশটিতে প্রচণ্ড তাপমাত্রা উপেক্ষা করে হাজীরা হজের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। গতকাল হাজীদের মক্কা থেকে মিনায় নিয়ে যাওয়া হয়। মিনায় যাওয়ার জন্য সকাল থেকেই সবাই প্রস্তুতি নেন। এর আগে পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ করেন তারা। তবে মিনায় যাওয়ার প্রস্তুতির কারণে এদিন জোহরের পর থেকে তাওয়াফকারীদের ভিড় কমে যায়।

সূত্রমতে, রোববার মক্কার হোটেল থেকে সবাই এহরামের কাপড় পরে ৬ কিলোমিটার দূরে তাঁবুর শহর হিসেবে খ্যাত মিনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। সেখানে পৌঁছে নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থান নেন হজযাত্রীরা। আজ সোমবার জোহরের আগেই সব হজযাত্রী মিনায় পৌঁছাবেন। সেখানে সারা দিন তাঁবুতে অবস্থান করে নামাজ ও অন্যান্য নফল ইবাদত করে কাটাবেন তারা। এরপর আজ রাত থেকেই মিনা থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে বাসে করে নিয়ে যাওয়া শুরু হবে হজযাত্রীদের। অনেকে আবার হেটেই আরাফাতের ময়দানে পৌঁছাবেন।

আগামীকাল মঙ্গলবার ৯ জিলহজ সকাল থেকেই ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে অস্থায়ী তাঁবুতে এবং অনেকে খোলা জায়গায় অবস্থান নেবেন। এ সময় হজযাত্রীদের মুখে ‘লাব্বাই আল্লাহুম্মা লাব্বাইক..’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠবে আরাফাতের ময়দান। দুপুরে মসজিদে নামিরাহ থেকে প্রচারিত হবে পবিত্র হজের খুতবা। হাজীরা এই খুতবা শুনবেন। সূত্রমতে, এ বছর হবের খুৎবা প্রদান করবেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য (সদস্য হাইয়্যাতুল কিবারুল ওলামা) ফজিলাতুশ শাইখ ডক্টর ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ।

এদিকে ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান শেষে সন্ধ্যায় মুজদালিফায় গিয়ে রাতযাপন করবেন হাজীরা। মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন শেষে ১০ জিলহজ সেখান থেকে ছোট ছোট কঙ্কর সংগ্রহ করে পুনরায় মিনায় গিয়ে বড় শয়তানকে (জামারায়ে উকবা) কঙ্কর নিক্ষেপ করে কোরবানি শেষে মাথা মু-ন করে হালাল (ইহরাম খুলবেন) হবেন তারা।

এর পর মক্কায় গিয়ে তাওয়াফে জিয়ারত (তাওয়াফ ও সায়ি) শেষে আবার মিনায় গিয়ে (ছোট, মধ্যম ও বড়) শতানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে হাজীদের। এভাবে ১২ জিলহজ পাথর নিক্ষেপ পর্বের মধ্য দিয়ে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে।

ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, রোববার রাতে বাংলাদেশ হজ অফিস মক্কার কনফারেন্স কক্ষে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের (এমপি) সভাপতিত্বে একটি বিশেষ সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় হজ ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ প্রস্তুতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সভায় অন্যান্যের মধ্যে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, ধর্ম সচিব মু. আ. হামিদ জমাদ্দার, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হজ) এবং প্রশাসনিক দলের দলনেতা মো. মতিউল ইসলাম, কাউন্সিলর (হজ) মো. জহিরুল ইসলাম, প্রশাসনিক দলের সদস্যবৃন্দ, চিকিৎসক এবং আইটি দলের দলনেতারাসহ অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

২৬ হজযাত্রীর মৃত্যু: পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গিয়ে এখন পর্যন্ত ২৬ বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ মৃত ব্যক্তির নাম মনোয়ারা বেগম (৭২)। তার পাসপোর্ট নম্বর ইপি ০০৬৮৮৩৫।

মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে ২২ জন পুরুষ ও চারজন নারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে মক্কায় মারা গেছেন ২২ জন এবং মদিনায় চারজন।

উল্লেখ্য, সৌদি আরবে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে বুধবার। এর পরের দিন বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে।