পবিত্র হজ পালিত

‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখর আরাফাত ময়দান

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সৌদি আরবের ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে অবস্থান ও খুতবা শোনার মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেন হাজীরা। সারা বিশ্বের ২০ লাখের বেশি মুসলমান দিনভর অবস্থান করেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিদায় হজের স্মৃতিবিজড়িত ওই ময়দানে। সবার কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আরাফাত ময়দান।

গত সোমবার পবিত্র মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে এবারের হজের পাঁচ দিনের ধারাবাহিক কার্যক্রম শুরু করেন হজ পালনকারীরা। দ্বিতীয় দিনে হজের মূল কাজ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে পৌঁছান অধিকাংশ হজ পালনকারী। সোমবার মধ্যরাত থেকেই বাসে করে আরাফাত ময়দানে উপস্থিত হওয়া শুরু করেন হাজিরা। এ সময় যানবাহনের দীর্ঘ সারি পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া অনেককে গতকাল মঙ্গলবার ফজর নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে নামিরায় উপস্থিত হতে দেখা যায়। দিনের আলো ফোটার পর অনেকে হেঁটেও আরাফাত এলাকায় হাজির হন। নিয়মানুযায়ী সেখানে অস্থায়ী তাঁবু, মসজিদে নামিরা এবং আশপাশের খোলা স্থানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন সবাই। খুতবা শোনা ছাড়াও অনেকে ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটান।

গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় (বাংলাদেশ সময় সাড়ে ৩টায়) মসজিদে নামিরা থেকে হজযাত্রীদের উদ্দেশে খুতবা শুরু হয়। খুতবা দেন সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সদস্য শায়খ ড. ইউসুফ বিন মুহাম্মদ বিন সাঈদ। খুতবায় বিশ্ব মুসলিমের দিকনির্দেশনামূলক নানা বিষয় তুলে ধরেন তিনি।

আরবিতে দেয়া হজের খুতবা তাৎক্ষণিকভাবে অনুবাদ করে আরো ২০ ভাষায় সম্প্রচার করা হয়। এবার টানা চতুর্থবারের মতো বাংলা ভাষায় হজের খুতবা শোনা যায়। এবার খুতবার বাংলা অনুবাদ করেন ড. খলীলুর রহমান ও আ ফ ম ওয়াহিদুর রহমান। তাদের সঙ্গে আরো ছিলেন মুবিনুর রহমান ফারুক ও নাজমুস সাকিব। তারা সবাই সৌদির বিখ্যাত উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

মানারাতুল হারামাইন অ্যাপ, আল কোরআন চ্যানেল ও আস সুন্নাহ চ্যানেলসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইউটিউব, ফেইসবুক ও টুইটারে খুতবাটি শোনা যায়। আরাফাত ময়দানে অবস্থান করাই হজের অন্যতম মূল কাজ। চার বর্গমাইল আয়তনের এই বিশাল সমতল মাঠের দক্ষিণ দিকে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড, উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফা সীমান্ত পশ্চিমে আরো প্রায় পৌনে এক মাইল বিস্তৃত।

হজের খুতবা শেষে জোহর ও আসরের নামাজ সংক্ষিপ্ত করে একত্রে আদায় করা হয়। নামাজে ইমামতি করেন শায়খ ইউসুফ।

এরপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজীরা আরাফার ময়দানে অবস্থান করে আল্লাহ তায়ালার জিকির-আসকার ইবাদতে দোয়ায় মশগুল ছিলেন। এরপর মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফার ময়দান ত্যাগ করেন সবাই। মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ এশার ওয়াক্তে একত্রে পড়েন এবং সেখানে সারা রাত অবস্থান করেন। মিনায় জামরাতে নিক্ষেপ করার জন্য ৭০টি পাথর সেখান থেকে সংগ্রহ করেন।

আজ মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজীরা মিনায় ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড় বদল করবেন। এরপর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে পবিত্র কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়ানো) করবেন। সেখান থেকে তারা আবার মিনায় যাবেন।

মিনায় আরো দুই দিন অবস্থান করে তিনটি (বড়, মধ্যম, ছোট) শয়তানকে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবেন। আবার মক্কায় গিয়ে বিদায়ী তাওয়াফ করার পর নিজ নিজ দেশে ফিরবেন হাজীরা।

তীব্র গরম নিয়ে হাজীদের জন্য সতর্কতা: তীব্র গরম নিয়ে হাজীদের উদ্দেশে সতর্কতা উচ্চারণ করেছে সৌদি আরব। একইসঙ্গে হাজীদের উদ্দেশে বেশ কিছু পরামর্শও দিয়েছে দেশটি। গতকাল এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার মধ্যে হজের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হাজিদের তাপ ক্লান্তি সম্পর্কে সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছে বলে জানিয়েছে সৌদি প্রেস এজেন্সি (এসপিএ)।

সৌদির এই মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলেছে, তীব্র রোদের মধ্যে ছাতা ব্যবহার করা, প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয় পান করা, শারীরিক পরিশ্রম এড়ানো এবং স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুসরণ করা হলে তা হিটস্ট্রোক বা তাপ সংশ্লিষ্ট যে কোনো চাপ থেকে হাজীদের রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে।

গ্র্যান্ড মসজিদ এবং মসজিদে নববীবিষয়ক জেনারেল প্রেসিডেন্সি এ পর্যন্ত ১০ হাজার ছাতা হাজীদের মধ্যে বিতরণ করেছে। এছাড়া হাজীদের তাদের যাত্রাপথজুড়ে জমজমের পানি পানের সুযোগও রাখা হয়েছে।

এদিকে ২০২০ সালের করোনা মহামারি হানা দেয়ার পর এবারই প্রথমবারের মতো সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ তুলে দেয়া হয়েছে। এতে করে এবার একসঙ্গে হজ করছেন ২০ লাখেরও বেশি মানুষ।

সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রী ড. তৌফিক আল-রাবিয়া বলেছেন, এবার বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২০ লাখের অধিক মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করবেন। আরাফাত ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। মধ্যে ২ মাইল দৈর্ঘ্য ও ২ মাইল প্রস্থের এই সমতল ভূমি। জাবাল মানে পাহাড়। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) জাবালে রহমত পাহাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, এই পাহাড়ে হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.) এর দেখা হয়েছিল।

হজ বিশ্বের বৃহত্তম বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশগুলোর একটি। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এই আনুষ্ঠানিকতা। মুসলমানদের অবশ্যই জীবনে অন্তত একবার হলেও হজ করা ফরজ; তবে এই শর্ত শুধু সামর্থ্যবানদের জন্য।

এদিকে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ হিসেবে আজ সৌদি আরবের সাধারণ মানুষ পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন এবং কোরবানি আদায় করবেন। নিয়ম না থাকায় হাজীরা ঈদের নামাজ পড়বেন না, তাদের মধ্যে ঈদের কোনো আমেজও থাকবে না। তারা সবাই হজের বাকি কাজ সম্পন্ন করতেই ব্যস্ত থাকবেন।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ পোর্টাল সূত্র মতে, বাংলাদেশ থেকে এবার এক লাখ ২২ হাজার ৮৮৪ জন পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরব গেছেন। এরমধ্যে বার্ধক্য ও অসুস্থতাজনিত কারণে এ পর্যন্ত ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। হজ শেষে ২ জুলাই থেকে হাজীদের দেশে ফেরার ফ্লাইট শুরু হবে। ২ আগস্ট পর্যন্ত এ ফ্লাইট চলবে।