পবিত্র ঈদুল আজহা কাল

ত্যাগ ও আনন্দের মহিমায় উদযাপনের প্রস্তুতি সর্বত্র

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রকীবুল হক

দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। সকালে ঈদগাহ বা মসজিদে জামাতের সঙ্গে ঈদের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ আদায়ের পর মহান আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হালাল পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে অন্যতম ধর্মীয় এ উৎসব উদযাপন করবেন দেশের মুসলমানরা। এরমধ্য দিয়ে ঘরে ঘরে ত্যাগ ও আনন্দের মহিমায় উজ্জীবিত হবে সবার মন। জিলহজ মাসের ১০ তারিখের এই দিনে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনে দেশের সর্বত্রই চলছে শেষ প্রস্তুতি। করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে গত তিন বছর পর এবার শর্তহীন ও অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে উদযাপিত হবে এই ঈদ। বর্ষা ঋতুর কারণে ঈদের সময় বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকলেও সেটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সবাই।

পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে আলাদা বাণী দিয়েছেন। এছাড়া জাতীয় সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টি এবং বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও ঈদের শুভেচ্ছা বাণী প্রদান করেছেন।

রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে তিনি বলেন, কোরবানি আমাদের মাঝে আত্মদান ও আত্মত্যাগের মানসিকতা সঞ্চারিত করে, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার মনোভাব জাগ্রত করে এবং সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।

রাষ্ট্রপতি বলেন, মহান আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদুল আজহা। ‘আজহা’ অর্থ কোরবানি বা উৎসর্গ করা। ঈদুল আজহা উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে চরম ত্যাগের শিক্ষা ও প্রভু প্রেমের পরাকাষ্ঠা। মহান আল্লাহর নির্দেশে স্বীয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে হযরত ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর প্রতি অগাধ ভালোবাসা, অবিচল আনুগত্য ও অসীম আত্মত্যাগের যে সুমহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে অতুলনীয়।

প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রিয়বস্তুকে উৎসর্গের মাধ্যমে তার সন্তুষ্টি লাভে যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা বিশ্ববাসীর কাছে চিরকাল অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। প্রতিবছর এ উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছল মুসলমানরা কোরবানিকৃত পশুর গোস্ত আত্মীয়স্বজন ও গরিব-দুঃখীর মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে মানুষে-মানুষে সহমর্মিতা ও সাম্যের বন্ধন প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তি, সহমর্মিতা, ত্যাগ ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয় ঈদুল আজহা।

শেখ হাসিনা বলেন, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে মুসলমানদের ত্যাগ, আত্মশুদ্ধি, সংযম, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মেলবন্ধন পরিব্যাপ্তি লাভ করুক- এটাই হোক ঈদ উৎসবের ঐকান্তিক কামনা। হাসি-খুশি ও ঈদের অনাবিল আনন্দে প্রতিটি মানুষের জীবন পূর্ণতায় ভরে উঠুক। আসুন, আমরা সকলে পবিত্র ঈদুল আজহার মর্মবাণী অন্তরে ধারণ করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জনকল্যাণমুখী কাজে অংশ নিয়ে বৈষম্যহীন, সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।

প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ত্যাগ ও আনন্দের বার্তা নিয়ে মুসলমানদের দুয়ারে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল আজহা। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের মুসলমানের কাছে ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ হিসেবে পরিচিত। এদিন মুসলমানরা জামাতের সঙ্গে ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং সাধ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, উট ইত্যাদি পশু কিনে কোরবানির মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করেন।

কয়েক হাজার বছর আগে এদিনে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর নির্দেশে তার সন্তুষ্টি লাভের জন্য হজরত ইব্রাহিম (আ.) পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়ে আল্লাহর রাস্তায় আত্মত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে আল্লাহর ইশারায় একটি দুম্বা কোরবানির মাধ্যমে সে নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়। এরপর থেকেই মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের নিদর্শন হিসেবে প্রতিবছর গৃহপালিত পশু কোরবানির মাধ্যমে আত্মত্যাগের প্রতীকী পরীক্ষা দেয়ার বিধান চালু হয়। পরে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে এ কোরবানি প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক (ওয়াজিব) করা হয়।

পবিত্র জিলহজের ১০ তারিখ ঈদুল আজহা উদযাপিত হলেও ধর্মীয় বিধান অনুসারে পবিত্র এ মাসের ১০, ১১ এবং ১২ তারিখের যে কোনোদিনই পশু কোরবানি দেয়া যায়। জিলহজ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পবিত্র হজ। সৌদি আরবের পবিত্র আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের মধ্য দিয়ে ৯ জিলহজ তথা গতকাল মঙ্গলবার হজের মূল কাজ শেষ হয়েছে। ১২ জিলহজ পর্যন্ত অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন হাজীরা। অন্যদিকে সৌদি আরবে আজ পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে।

দেশে ঈদুল আজহা উদযাপনে এরইমধ্যে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছেন সর্বস্তরের মুসলমান। তবে কোরবানির পশু কেনা এখনো শেষ হয়নি অনেকের। ঈদের আগে আজ শেষ দিনে প্রায় সবাই এ কাজটি সম্পন্ন করবেন। অনেক জায়গায় ঈদের দিনসহ পরবর্তী কয়েকদিনও কোরবানির পশু বেচাকেনা হয়ে থাকে।

এদিকে বাবা-মাসহ আপনজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে রাজধানী ঢাকাসহ প্রধান প্রধান নগরীর অধিকাংশ বাসিন্দা ও কর্মজীবী মানুষ নানা ভোগান্তি উপেক্ষা করে ছুটে চলেছেন নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে। আপনজনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগির চেষ্টা করবেন অনেকেই। বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও অন্যান্য যানবাহনে এখন ঘরমুখো মানুষের ভিড়। রাজধানী ঢাকা মঙ্গলবারই অনেকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। তবে নানা কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনজনের কাছে যেতে পারবেন না অনেকে। এছাড়া অনেকেই ঈদ করবেন কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ও হাসপাতালের বেডে। জরুরি সেবামূলক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত কর্মীরাও ভিন্ন আবহে ঈদ উদযাপন করবেন।

ঈদুল আজহার নামাজের জন্য রাজধানীতে জাতীয় ঈদগাহসহ দেশের সব ঈদগাহ মাঠ ও মসজিদে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের জাতীয় ঈদগাহে সকাল সাড়ে ৭টায় ঈদুল আজহার প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হবে। আর আবহাওয়া প্রতিকূল বা অন্য কোনো অনিবার্য কারণে এ জামাত অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে ঈদের প্রধান জামাত সকাল ৮টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত হবে।

এবারো বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পর্যায়ক্রমে ৫টি ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ৭টা, ৮টা, ৯টা, ১০টা ও ১০টা ৪৫ মিনিটে এসব ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্র জানায়, বায়তুল মোকাররমে ঈদের প্রথম জামাত হবে সকাল ৭টায়। এতে ইমাম থাকবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা এহসানুল হক। দ্বিতীয় জামাত সকাল ৮টায় অনুষ্ঠিত হবে। ইমাম থাকবেন বায়তুল মোকাররমের পেশ মাওলানা মুহীউদ্দিন কাসেম। ৯টার তৃতীয় জামাতের ইমাম হবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফাসসির মাওলানা আবু সালেহ পাটোয়ারি।

চতুর্থ জামাত হবে সকাল ১০টায়। এতে ইমাম থাকবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মাওলানা মো. আনিসুজ্জামান সিকদার। পঞ্চম ও সর্বশেষ জামাত হবে সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে। এতে ইমাম থাকবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।

পাঁচটি জামাতে কোনো ইমাম অনুপস্থিত থাকলে বিকল্প ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মাওলানা জাকির হোসেন। এছাড়া দুই সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ঢাকা মহানগরীর সব ঈদগাহে ঈদ জামাত হবে।

এদিকে রাজধানীতে কোরবানির ঈদের প্রধান জামাতের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গতকাল বলেছেন, নামাজের সময় ঝড় বৃষ্টি হলেও যাতে সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা নিয়েছে করপোরেশন।

সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে জামাতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষ্যে সবাইকে অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা জানাই এবং সবাইকেই আমি আমন্ত্রণ করব যেন জাতীয় ঈদগাহে এসে ঢাকাবাসী এই ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করেন।

এদিকে দিনাজপুরের গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে দেশের বৃহত্তম ঈদুল আজহার জামাত আয়োজনের সবধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

এছাড়া কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানেও অন্যতম বৃহৎ ঈদুল আজহার জামাত অনুষ্ঠিত হবে।

আন্তঃমন্ত্রণায় সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যথাযোগ্য মর্যাদা, ভাবগাম্ভীর্য এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আনন্দমুখর পরিবেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে সরকারি/বেসরকারি ভবন এবং বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় পতাকা ও ‘ঈদ মোবারক’ লিখিত ব্যানার ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ট্রাফিক আইল্যান্ড ও লাইট পোস্টে প্রদর্শন করা হবে।

বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি গণমাধ্যমসমূহ যথাযোগ্য গুরুত্ব সহকারে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার ও সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা হবে। এছাড়াও পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষ্যে দেশের সব হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশু সদন, বৃদ্ধ নিবাস ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হবে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস ও মিশনসমূহ যথাযথভাবে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপন করবে। এ উপলক্ষ্যে সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রক্ষার্থে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঈদ উপলক্ষ্যে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে আজ থেকে ৩ দিনের ছুটি শুরু হয়েছে। তাই আগামী তিন দিন পত্রিকা প্রকাশিত হবে না। বেসরকারি অফিসগুলোতে আজ থেকে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। তবে সরকারি অফিসে চার দিনের ছুটি শুরু হয়েছে গতকাল থেকে।