এ যুগের কোরবানি ও মানুষের কর্মব্যস্ততা

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শাহিনুর রহমান

রাজধানীর রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ির আঙিনা এবং অলিগলিতে সারি সারি কোরবানির গরু বাঁধা। এসব গরুর পরিচর্যায় সার্বক্ষণিক লোক নিয়োজিত। রাতে গরু চুরির ভয়ে পাহারা দেয়ারও লোক নির্দিষ্ট করা রয়েছে। বাসাবাড়ির দারোয়ান কিংবা নৈশ প্রহরীরা এসব গরু দেখাশোনা করছেন। গরুর খাবার দেয়া এবং তার দাম কত তা বলছেন প্রতিনিয়ত। কত কেজি মাংস হবে সেটা নিয়েও চলছে আলাপ-আলোচনা। দামের তুলনায় মাংস এবং বাজারের তুলনায় গরু কেনা লাভ হলো কি না কিংবা এবারের বাজারে গরুর দাম বেশি কিংবা কম কি না তা নিয়ে চলছে তুলনামূলক আলাপ-আলোচনা। রাস্তায় গরু দেখা মাত্র যে কেউ দাম জিজ্ঞাসা করেন। এটা এখন আর কোনো অভদ্রতা নয়। এটা যেন একটা স্বাভাবিক ঘটনা এবং আচরণ।

এদিকে কে গরু জবাই করবেন, কোন কসাইদল গরুর মাংস কাটবেন। তার পারিশ্রমিক কত হবে তা নিয়ে চলছে আলাপ-আলোচনা। একটা অলিখিত নিয়ম রয়েছে গরুর মাংস কাটার জন্য গরুর দামের প্রতি হাজার টাকা হিসেবে মাংস কাটার পারিশ্রমিক নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে কোনো কসাইদল কার গরুর মাংস আগে কাটবেন, কারটা পরে কাটবেন তার একটা তালিকা নিয়ে কসাইদলও এখন নানা হিসেব-নিকেশ শুরু করে দিয়েছে। কোন মাদ্রাসা বা এতিম খানায় গরুর চামড়া দেয়া হবে কিংবা কার কাছে চামড়া বিক্রি করে সেই টাকা কোন মাদ্রাসা বা কোন এতিম খানায় দেয়া হবে তা নিয়েও চলছে আলাপ-আলোচনা। তবে মহল্লার মাদ্রাসা মসজিদ গুরুত্ব পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঈদুল আজহার এক-দুই দিন পরও পশু কোরবানি দেয়া যায়। সে কারণে যারা ঈদের দিন কোরবানি দিতে পারেন না তারা ঈদের পরদিনও কোরবানি দেন। কোথায় গরুর দাম বেশি, শহরের নাকি গ্রামের তা নিয়ে চলে আলোচনা। গ্রামাঞ্চলে গরু রাখার জন্য অনেক ফাঁকা জায়গা রয়েছে সেখানে অনায়াসে গরু রাখা ও জবাই দেয়া যায় এবং সে কাজটি গ্রামের মানুষ নিজেরাই করে থাকে। অথচ শহরে গরু রাখার মতো জায়গা পাওয়া কঠিন। বাড়ির মালিক বাসার বাইরে এমন কোনো ফাঁকা জায়গা রাখেন না যে, সেই বাড়ির বাসিন্দারা সেখানে গরু রাখবেন। ফলে তারা পড়ে যান মহাসংকটে। কোরবানির পশু রাখার জন্য যে লোক নিয়োজিত থাকেন তার জন্য রয়েছে আলাদা পারিশ্রমিক। সেই সঙ্গে কোরবানির মাংস। বাড়তি হিসেবে গরুর ভূড়ি।

কোরবানির মাংস রাখার জন্য ঈদের আগেই ডিপ ফ্রিজ কেনন অনেকে। কোরবানির পশুর তিন ভাগের একভাগ গরির মিসকিন, একভাগ আত্মীয়-স্বজন এবং একভাগ নিজের জন্য রাখবেন এটাই প্রচলিত নিয়ম। তবে আমাদের দেশে কোরবানির মাংস কীভাবে বণ্টন করা হয় সেটা বাস্তব জ্ঞান দিয়ে অনেকেই অনুভব করতে পারেন। কোরবানির গরুর কোন অংশের মাংস কোন আত্মীয়কে দেয়া হবে তা নিয়েও একটা সাধারণ ধারণা দেশের অনেক এলাকায় প্রচলন রয়েছে। কোরবানির মাংস দিয়ে কোন ধরনের খাবার তৈরি করা হবে, কীভাবে রান্না করা হবে, মাংসের সঙ্গে অনুষঙ্গ খাবার বাছাই করা নিয়েও চলছে নানা আলাপ-আলোচনা। কোন সন্তান কোন মাংস খায় তা নিয়েও পারিবারিক আলোচনা থেমে নেই। অনেকে সন্তানদের ‘খুশি’ করতে কোরবানি দেন। আর্থিক সামর্থ্যবানদের জন্য পশু কোরবানি দেয়া ওয়াজিব। রোজার ঈদে মানুষ কেনা-কাটায় অর্থ ব্যয় করেন। কোরবানির ঈদে মানুষ অর্থ ব্যয় করেন কোরবানির পশু কোনায়। অনেকে সর্বোচ্চ সাত ভাগ কিংবা বেজোড় ভাগে কোরবানি দিয়ে থাকেন। যারা ভাগাভাগি করে কোরবানি দেন তাদের সবার নিয়ত যে ‘সহি-শুদ্ধ’ তা নিয়ে চলে না আলোচনা। অনেকে এই বিতর্ক এড়াতে এককভাবে খাসি কিংবা ছাগল কোরবানি দিয়ে থাকেন। দেশের দরিদ্রপ্রবণ এলাকা থেকে অনেক মানুষ রাজধানীতে আসেন কোরবানির মাংস সংগ্রহ করার জন্য। অনেকে এই মাংস বাড়ি নিয়ে যান আবার অনেকে সন্ধ্যা রাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু মাংস বিক্রি করে দেন। যাদের কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য নেই তারা সেই মাংস কিনে পারিবারিক প্রয়োজন মেটান। আমাদের সমাজে যারা কোরবানি দেন তারা অনেকটাই ‘ভাগ্যবান’। যার গরুর দাম যত বেশি সমাজে তার ‘মর্যাদা’ তত বেশি। কারো সঙ্গে এখন দেখা হলে কেন যেন প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘ আপনি গরু না ছাগল’। যাদের এই দুটি পশুর কোনোটাই কোরবানি করার সামর্থ্য নেই তারা লজ্জা-শরমের তোয়াক্কা না করে বলেন, ‘মুরগি’। কোরবানি ঈদের কয়েকদিন কোন আত্মীয় এবার কত টাকা দিয়ে গরু কিনলেন, সেই গরুর কত কেজি মাংস হলো তা নিয়েও চলে আলোচনা। কোরবানির দিনে মোবাইল ফোনের রিংটোন বারবার বেজে উঠবে। গরু কাটা শেষ হলো কি না, কত কেজি মাংস হলো এসব নানা আলোচনা। গরুর ছবি তুলে নিকটজনের কাছে পাঠিয়ে কত কেজি মাংস হলো তা হিসাব করতে হাত পড়ে যায় মোবাইল ফোনের ক্যালকুলেটরের বোতামে। কোরবানির পশু তাজামোটা করে দশ-বিশ লাখ টাকায় বিক্রি করার দৃষ্টান্ত অনেককে উৎসাহিত করে। কোনো একটা পরিবার যদি সারা বছর একটি গরু মোটাতাজা করে ঈদের সময় বিক্রি করতে পারেন তা হলে তার পরিবারে একটা বড় অঙ্কের অর্থের সংস্থান হয়। নানা নামে ডাকা হয় এসব গরু। এসব নামের ক্ষেত্রে ক্রিকেট কিংবা চলচ্চিত্র তারকা অথবা ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা তার পদবি ব্যবহার করা হয়। নানা রকম বাহারি নামে গরুগুলোকে পরিচিত করে তোলা হয় কোরবানির হাটে। পশুর বাজারকে ‘বিরাট গরু ছাগলের হাট’ এই নামে লাউড স্পিকারে ঘোষণা দেয়া হয়। অথচ ‘বিরাট’ শব্দটি কোথায় বসবে তা কেবল ভাষাবিদরাই ভালো জানেন। কোরবানির পশু কেনা নিয়ে আলাপ-আলোচনার শেষ নেই। গরু কেনার পর কে গরুর আগে থাকবে, কে পেছনের দিকে থাকবে, রাস্তার লোকজনের কাছে দাম বলবে, সেই লোকও নির্ধারিত থাকে। গরু কেনার জন্য সময় একটা বড় ফ্যাক্টর। অনেকে মনে করেন কোরবানির আগের রাতে পশু কিনলে রাখার সমস্যা দূর করা সম্ভব। তবে শেষ দিনে পশু কেনা নিয়ে এক প্রকার অনিশ্চয়তাও থাকে। গরুর সরবরাহ কমে গেলে দাম বেড়ে যায়। আবার সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে য়ায়। তবে মোবাইল ফোনে গরু ব্যবসায়ীরা গরুর চাহিদা জানিয়ে দেয়ার পর চলে আসতে থাকে গরু। মোবাইল ফোনে টাকা পাঠানোর সহজতর ব্যবস্থা থাকায় গুরুর সরবরাহ নিয়ে তেমন একটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না। ডিজিটাল বাংলাদেশের এটাই তো সুবিধা।