ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদুল আজহায় পশুর চামড়া সংগ্রহ

ব্যস্ততা বেড়েছে ট্যানারি মালিক-শ্রমিকদের

ব্যস্ততা বেড়েছে ট্যানারি মালিক-শ্রমিকদের

কোরবানির পশুর চামড়াকে কেন্দ্র করে অন্যান্য বছরের মতো এবারো ট্যানারি পল্লি সরব হয়ে উঠেছে। চামড়া সংগ্রহ ও মজুদে ব্যস্ত সময় পার করছেন ট্যানারি মালিক-শ্রমিকরা। বৃষ্টির মৌসুমে চামড়া পচে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে দ্রুতই চামড়ায় লবণ লাগানো হচ্ছে। কারণ বছরজুড়ে দেশের চামড়া খাত পরিচালনায় এসব পশুর চামড়া সংরক্ষণ ও মজুদ করতে হবে।

রাজধানীর ট্যানারি মোড়, মাতুয়াইল, মিরপুর, উত্তরা ও গাবতলীসহ বিভিন্ন স্থানে ঈদের দিন রাতে ঘুরে দেখা গেছে, পুরোনো চামড়া ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করে মহল্লায় মহল্লায় অস্থায়ী চামড়ার আড়দারদের কাছে চামড়া বিক্রি করেন। অনেকে ট্রাক ও ভ্যানগাড়ির মাধ্যমে নিয়ে আসা কাঁচা চামড়াগুলো জড়ো করে রাখে। আর আড়তদাররা এসব চামড়া কিনে ট্যানারি পল্লির মালিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। তবে ঈদের দিনে শুরুতে ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি কম থাকলেও পরে জমতে শুরু করে। কিন্তু উল্টো রথে চলে ছাগলের চামড়া সংগ্রহের কার্যক্রম। কারণ ছাগলের চামড়া নিয়ে কোনো আগ্রহই ছিল না আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের। অনেকে ছাগলের চামড়ার দরদাম করেননি। বিক্রেতারা ছাগলের চামড়া নামমূল্যে বিক্রি করেন।

ঈদের দিন রাতে সংগ্রহ করা কাঁচা পশুর চামড়া আড়তদাররা পাড়া-মহল্লা থেকে সংগ্রহ করে পুরান ঢাকার ট্যানারি পল্লি ও সাভার ট্যানারিতে নিয়ে যান। টানা দুই দিন এসব চামড়ায় লবণ মাখাতে ব্যস্ত সময় পার করেন ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকরা।

এবার ঈদের দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর ট্যানারিতে প্রায় ৪ লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। অন্যদিকে ট্যানারির বাইরে অবস্থিত আড়তগুলোতে সংগ্রহ করা হয়েছে ১০ লাখের কাছাকাছি চামড়া। এসব পশুর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন ট্যানারিগুলো। গতকাল রোববার সাভার ট্যানারি পল্লিতে গেলে ট্যানারি মালিক ও শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ে। সারা বছর যে পরিমাণ কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তার অর্ধেকই সংগ্রহ করা হয় কোরবানির ঈদে। সব ট্যানারি কারখানায় লবণ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। কোথাও কাঁচা চামড়ায় লবণ মাখিয়ে রাখা হয়েছে, কোথাও ড্রামভর্তি রাসায়নিক দ্রব্য। ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি থেকে কাঁচা চামড়া নামাচ্ছেন শ্রমিকরা।

সজল লেদার লিমিটেডের মালিক সজল বলেন, ঈদুল আজহায় বছরের সবচেয়ে বেশি চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এ কারণে সময়টা ব্যস্ত কাটে। অল্প সময়ের মধ্যে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। তা না হলে চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি বলেন, এবার কমবেশি ৪০ হাজার কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করেছি। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করার কাজ চলছে।

গত ১০ বছর ধরে ট্যানারিতে ঠেলাগাড়ি দিয়ে চামড়া আনা-নেয়া করেন জাহিদ সরকার। তিনি বলেন, কোরবানির ঈদ এলে ব্যস্ততা বাড়ে। অন্যান্য সময়ে ৭-৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এখন দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে।

ট্যানারি শ্রমিক মোজাম্মেল হোসেন একই কথা বলেন। তিনি বলেন, কাঁচা চামড়ায় লবণ দিয়ে রাখছি। ভালো করে লবণ দিয়ে রাখলে এক থেকে দুই মাস পর্যন্ত চামড়া এ অবস্থায় রাখা যায়। এরপর ধোলাই, সোডিয়াম, বেড সালফার লাগানো হবে। এছাড়া লবণে একটু হেরফের হলে চামড়া নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখন বৃষ্টির সময়, তাই লবণ দিয়ে চামড়া ঢেকে রাখতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি। ট্যানারি মালিক জিহাদ মিয়া বলেন, কাঁচা চামড়ায় ৭-৮ ঘণ্টা লবণ না দিলে নষ্ট হয়ে যায়। এবার লবণের অনেক বেশি দাম। আমাদের মতো ছোট কারখানার মালিকরা লবণ কিনতে গিয়ে বিপদে পড়েছি। ৬০ কেজি লবণের বস্তা দেড় হাজার টাকার কাছাকাছি।

কয়েকটি ট্যানারির মালিকের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত লবণ এবং কেমিক্যালের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে তারা সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া ক্রয় করা থেকে বিরত থাকছেন। যে কারণে চামড়া বিক্রেতারা বিভিন্ন ট্যানারি ঘুরেও কাঙ্ক্ষিত দামে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে হতাশ হয়েছেন। তবে তাদের সেই হতাশার মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনে দিয়েছেন ট্যানারির বাইরে অবস্থিত আড়ত মালিকরা।

ট্যানারি থেকে হতাশ হয়ে ফিরে চামড়া ব্যবসায়ীরা অপেক্ষাকৃত অধিক মূল্যে এসব আড়তে চামড়া বিক্রি করতে পেরে কিছুটা হলেও খুশি হয়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আড়াইশ’ চামড়া ক্রয় করেছিলেন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সুরজ মিয়া। ঈদের দিন বিকালে সেসব চামড়া নিয়ে সাভারের বিভিন্ন ট্যানারিতে ঘুরে ক্রয় মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রির প্রস্তাব পান তিনি। অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ট্যানারির বাইরে অবস্থিত চামড়ার আড়তের সামনে গাড়ি থামান। এ সময় কয়েকজন ব্যবসায়ী তার চামড়াগুলো ক্রয় মূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি দিয়ে চামড়াগুলো রেখে দেন। এর ফলে দীর্ঘ ক্লান্তি এবং চিন্তার মধ্যে কিছুটা স্বস্তির কথা জানান তিনি।

ট্যানারি পল্লিতে আপাতত চামড়াগুলো লবণজাত করে রাখা হয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আরো ৯০ লাখ চামড়া লবণজাত করে রাখা হয়েছে। এবার কোনো ব্যবসায়ীকে চামড়া ফেলে দিতে দেখা যায়নি। বছরের অন্য সময়ের চেয়ে কোরবানির সময়কার হিসাব একদমই আলাদা। কারণ এ সময় ৫০ শতাংশের বেশি চামড়া সংগৃহীত হয়। চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা জানান, গত বছরের তুলনায় এবার গরুর কাঁচা চামড়ার দাম কিছুটা বেশি ছিল। প্রতিটি চামড়া সর্বোচ্চ সাত টাকা থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন দুই টাকা পর্যন্ত হয়েছে। তবে ছাগলের চামড়া আকারে ছোট হওয়া ও সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে চামড়াপ্রতি খরচ বেশি হওয়ায় ছাগলের চামড়া কেনার আগ্রহ কম ছিল। এটি শুধু রাজধানীই নয়, সারা দেশে ছাগলের চামড়ার দাম কম ছিল। নামমূল্যে পাঁচ টাকা বা তারো কম দামে প্রতি পিস ছাগলের চামড়া কেনা হয়। অনেকে ছাগলের চামড়া ফ্রি দিয়েছে আড়তদারদের। কারণ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় অনেক চামড়া নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত শনিবার ধানমন্ডির ইমপেরিয়াল আমিন আহমেদ সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ বলেন, ঈদের প্রথম দুই দিনে চার থেকে সাড়ে চার লাখ পিস চামড়া ট্যানারিতে সংগ্রহ করা হয়েছে। আর সারা দেশ থেকে চলতি বছর ৯০ থেকে ৯৫ লাখ চামড়া সংগ্রহ হবে।

তবে গত শুক্রবার প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ বছর ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। গত বছর সারা দেশে কোরবানিকৃত গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি। গত বছরের তুলনায় এবার ৯১ হাজার ৪৯টি গবাদিপশু বেশি কোরবানি হয়েছে। আর দেশের সর্বোচ্চ পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে, সর্বনিম্ন ময়মনসিংহ বিভাগে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নজর দিতে হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী বাড়াতে হবে। বিনিয়োগকারীদের অব্যবস্থাপনা দূর করে প্রায় ৪০টি বিদেশি বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা গেলে চামড়া খাতে আমূল পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক চামড়ার বাজার ৪২০ বিলিয়ন ডলারের। ২০৩২ সালের মধ্যে বাজার হবে ৭৩৫ বিলিয়ন ডলারের। প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৈশ্বিক এই বাজার বাড়ছে। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করতে চায়, যা বর্তমানে ১০০ কোটি ডলার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত