পঞ্চগড়ে চা শিল্প

দরিদ্রতা ঘুচিয়ে চাঙা সবুজ অর্থনীতি

প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এসকে দোয়েল পঞ্চগড় থেকে

দুই দশকের চায়ের নীরব বিপ্লবে অর্থনীতিতে বদলে গেছে উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। কঠিন দরিদ্রতা ঘুচিয়ে এনে দিয়েছে চাঙা সবুজ অর্থনীতি। এতে বদলে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, কর্মসংস্থান ও গড়ে উঠেছে জীবনযাপনের আবাসন স্থাপত্য। হাজার হাজার অনাবাদি গো-চারণ পতিত জমি হয়ে উঠেছে সমতলের চা ভূ-স্বর্গ। ঘর, হোটেল- রেস্টুরেন্টে, আড্ডা ও আলোচনা সভায় ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে চা পান। চাঙ্গা অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পর্যটনের নতুনমাত্রা।

দুই দশকের চা শিল্পের নীরব বিপ্লবে এখন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পরের অবস্থানে পঞ্চগড়। চা বাগানের ক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে তৃতীয় চা অঞ্চল। আর চা উৎপাদনে দ্বিতীয় অঞ্চল হিসেবে জায়গা করে নিয়ে হয়ে উঠেছে চা শিল্পখ্যাত অঞ্চল। চা পরিকল্পনা শুরু ১৯৯৬ সালে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরে এসে চা চাষের সম্ভাবনার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই চিন্তার ফসল আজকের এ চা বাগান। সে সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রবিউল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ করা হয়। প্রথমে টবে, পরে জমিতে চায়ের চাষ করা হয়। সে সফলতা থেকে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা উৎপাদন করা হয়। ১৯৯৯ সালে উত্তরবঙ্গে চা চাষের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ চা বোর্ডেও প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট ও বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি বিশেষজ্ঞ দল পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় জরিপ চালিয়ে চা চাষের সম্ভাবনা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। জরিপ কমিটি পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় প্রায় ৪০ হাজার একর জমিতে চা চাষের সম্ভাবনা নির্ধারণ করেন। বাণিজ্যিকভাবে চা বাগানের যাত্রা ২০০০ সালের দিকে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের হাত ধরে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা বাগান চাষ শুরু হয়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিটিআরআই) একটি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে পঞ্চগড়ে মতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ইসহাক আলী মণ্ডল, আবদুর রহমান, আবুল হোসেনসহ ছয় থেকে সাতজন ক্ষুদ্র চাষি চা চাষ শুরু করেন। এখান থেকেই বাড়তে থাকে পরিধি। একসময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি হয়ে ওঠে বিস্তৃত সবুজ চা বাগান। এক সময় একরের একর জমি অনাবাদি পতিত জমি ঝাড়জঙ্গল হিসেবে পড়ে থাকত, সেসব পতিত জমিতে শুরু করা হয় চা চাষ। চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ চা বোর্ড কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ঋণ ও বিভিন্ন উৎসাহ প্রদান করে। বাগানের কাঁচা পাতা বিক্রি করে হাতে নগদ অর্থ আসার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের বাড়ির আঙিনাটুকুও হয়ে উঠেছে চা বাগান। বাগানের পরিমাণ, চাষি ও চা উৎপাদন চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, চা উৎপাদনে সিলেটের পর দ্বিতীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছে এ জেলা। প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে সাত হাজার চা-বাগান। নিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা বাগান রয়েছে ১ হাজার ১৬৮টি। অনিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে ৬ হাজার। নিবন্ধিত ৮৯১ জন এবং অনিবন্ধিত ৫০১৮ জন ক্ষুদ্র চা চাষি রয়েছেন। ১৮২ জন স্মল গ্রোয়ার্স রয়েছেন, যাদের জমি ৫ একরের নিচে। ১১ জন স্মল হোল্ডার্স, যাদের চা বাগান ৫ থেকে ২০ একরের মধ্যে। ২০ একরের উপরে ১৯টি এস্টেট। বর্তমানে জেলায় ২৩টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে। এসব কারখানা থেকে গত বছর এক কোটি ৫২ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে। বিগত বছরে ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজি, ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার চা উৎপাদন হয়েছে। চা বাগানেই মিশ্র চাষে লাভবান কৃষক সবুজ চা পাতা ছাড়াও চাষিরা চা বাগানে মিশ্র ফসল চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। তারা চা বাগানে এখন বিভিন্ন উন্নত প্রজাতির আম, মাল্টা, পেঁপে, সুপারি, তেজপাতা, আমলকি ও মেহগনিসহ নতুন বাগানে মরিচসহ বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ করে বাড়তি আয় করেছেন। গত এক দশকে এক চা বাগানে এসব মিশ্র ফসল চাষ করে সফল হয়েছেন অনেক চাষি।

গড়ে উঠেছে কর্মসংস্থান: সমতলের চা বাগান ঘিরে বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। জেলার লক্ষাধিক মানুষ জড়িয়ে পড়েছেন চা শিল্পে। বেকারদের একটি বড় অংশ চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে চা চাষে বিনিয়োগ করেছেন। এতে করে হাজার হাজার নারী-পুরুষের কাজের কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থনীতিতেও স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা। চা অর্থকরী ফসল হিসেবে বছরের নয় মাস চলে বাগানের বিভিন্ন কাজ। বাগানের পরিচর্যার কাজ হিসেবে রয়েছে ফ্লাইং কাটিং অর্থাৎ গাছের মাথা ফ্লাইং কাটিং, পুরুনিং, সার ও কীটনাশক স্প্রে, পানি নিষ্কাশন। তিন মাস বাগান পরিচর্যার পর নতুন কুঁড়ি গজে ওঠে। এর মাস খানেকের মধ্যেই শুরু হয় পাতা তোলা। শ্রমিকরা বাগানে বাগানে দলবেঁধে কেজিতে ৩-৪ টাকা চুক্তিতে পাতা তোলেন। দিনশেষে শ্রমিকদের হাতে আসে ৫০০ থেকে তারো বেশি টাকা। পাতার দাম বাড়লে শ্রমের দাম বেড়ে যায়। কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে চা কারখানাগুলোতেও।

শ্রমিক থেকে চা বাগানের মালিক: চা শিল্প ঘিরে শুধু চা চাষি ও চা শ্রমিক অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটেনি। শ্রমিক থেকে অনেকেই হয়ে উঠেছেন চা বাগানের মালিক। নিজের জমি না থাকলেও অন্যের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে ভূমি লিজ নিয়ে বাগানের মালিক হয়েছেন। অর্থনৈতিক সচ্ছলতায় বদলে গেছে আর্থ-সামাজিকতা, বেড়েছে আভিজাত্যের পরশ। ছনের ছাউনির জায়গায় ইট-কংক্রিটের ঘরবাড়ি। স্ত্রী-সন্তানের ভরণ-পোষণ ও লেখাপড়ায় খরচ করতে পারছে। উন্নত হয়েছে গ্রামীণ পরিবেশ। আধুনিকতার শহরের আদলে গড়ে উঠছে চা গ্রাম। পঞ্চগড়ে পৃথিবীর সেরা চা উৎপাদিত হচ্ছে। বাংলাদেশে একমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ১০০ ভাগ অর্গানিক চা উৎপাদন করছে কাজী অ্যান্ড কাজী। তাদের চা বাগান সম্পূর্ণ কম্পোজিট টি এস্টেট। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে অর্গানিক চা উৎপাদনে খ্যাতি পেয়েছে কাজী অ্যান্ড কাজী। এই অর্গানিক চা উৎপন্ন হয়ে বিক্রি হচ্ছে লন্ডনের হ্যারোড অকশন মার্কেটে। রপ্তানি হচ্ছে দুবাই, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে। দেশীয় বাজারে চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে এখানকার চা। চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের পর দেশের চায়ের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র গড়ে উঠছে এ জেলায়। উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট থেকে উৎপাদিত চা এই নিলাম কেন্দ্রে বিক্রির পরিকল্পনা করা হয়েছে। চলতি মাসেই চালু হচ্ছে চায়ের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে চা বোর্ড। নিলাম কেন্দ্র ঘিরে স্থাপিত হয়েছে ব্রোকার ও ওয়্যার হাউজ।

বাড়িয়ে দিয়েছে পর্যটনের সম্ভাবনা: সমতলে চা বাগান ঘিরে সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে পর্যটন শিল্পের। গ্রামীণ পর্যটন হিসেবে ইকো ট্যুরিজম ও গ্রিন ট্যুরিজমের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে কৃষিতে চা শিল্প। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের উত্তরের সীমান্ত জনপদ পঞ্চগড়ে গড়ে ওঠা চা শিল্প গ্রামীণ পর্যটনে নতুনমাত্রা দিয়েছে। চা শিল্পটাকে ফার্মিং ট্যুরিজমের মধ্যেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। প্রতি বছর সিলেটে, মৌলভীবাজার ও চট্টগ্রামে চা বাগান দেখতে পাড়ি দেয় লাখ লাখ পর্যটক। সিলেট-চট্টগ্রামের মতোই চা বাগান পর্যটনে নতুনমাত্রা তৈরি করেছে। সমতল ভূমিতে চা ভূ-স্বর্গ গড়ে উঠলেও তৈরি হয়েছে নানা সংকট। এসব সংকটের মধ্যে রয়েছে চাষিদের তাদের উৎপাদিত চা পাতার ন্যায্য দাম না পাওয়ার অভিযোগ। এতে করে তারা চরম হতাশ। কৃষকদের অভিযোগ, কয়েক বছর ধরেই তারা পাচ্ছেন না চা পাতার ন্যায্য দাম। শক্তিশালী সিন্ডিকেটের যাঁতাকলে ইংরেজ নীলকরদের মতোই চুষে নেয়া হচ্ছে কৃষকদেও উৎপাদিত পণ্য। প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। উৎপাদিত চা পাতা বিভিন্ন অজুহাতে চা কারখানার মালিকরা ৪০-৫০ শতাংশ কেটে নিচ্ছেন। এতে উৎপাদনের খরচও তুলতে পারছেন না। এ পরিস্থিতি নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর উপরই ভরসা করছেন তারা। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের উপর ভর করে দেশের অর্থনীতি ও খাদ্য ভাণ্ডার মজুদ হচ্ছে সেই কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত সবুজ অর্থনীতির ন্যায্যমূল্য পান তার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে কারখানার মালিকদের দাবি, চাষিরা কারখানায় ভালোমানের পাতা দিতে পারছেন না। দুটি পাতা একটি কুড়ি অর্থাৎ তিন পাতা থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত বর্তমান নির্ধারিত ১৮ টাকায় কেনা যায়। কিন্তু চাষিরা বাগান থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে ৭-৮ পাতা পর্যন্ত নিয়ে আসায় সে দামে কেনা সম্ভব হয় না। ভালোপাতা না পেলে যেমন প্রডাকশন ভালো হবে না, সে প্রডাকশন চা নিলাম বাজারে দাম না পেলে কৃষকদেরও ন্যায্য দাম দেয়া সম্ভব নয়। তাই চাষিদেও চায়ের ওপর প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম দিয়ে যদি বাগান থেকে পাতা উত্তোলন করা যায়, তাহলে চাষি ও কারখানা উভয়ই লাভবান হলে টিকে থাকবে এ চা শিল্প। গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেটের চা কারখানার ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম জানান, চট্টগ্রামের অকশন মার্কেটে সিলেটের তৈরিকৃত চায়ের তুলনায় আমাদের চায়ের দাম কম। কারণ তারা যে নিয়ম মেনে বাগান থেকে চা উত্তোলন করে, আমরা সেই নিয়মের ধারেরকাছেও নেই। আমাদের এখানকার ক্ষুদ্র চা চাষিরা হাতের বদলে কাঁচি দিয়ে আট থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত ডালসহ কেটে কারখানায় নিয়ে আসেন। অথচ নির্ধারণ করা আছে চার থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত। এ কারণে আমরাও চায়ের মান ঠিক রাখতে পারছি না। যার কারণে আমাদের চায়ের চাহিদা কমে যায়। চাহিদা কমে গেলে দামও কমে যায়। তাই চা চাষিরা ভালো মানের পাতা সরবরাহ করলে আমরা মূল্য নির্ধারণ কমিটির দর অনুযায়ী কাঁচাপাতা কিনব। সেক্ষেত্রে আমরাও ভালো মানের চা উৎপাদন করতে পারব এবং অকশন মার্কেটে আমাদের চায়ের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের জেলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, ‘সমতল ভূমিতে চা চাষে উত্তরাঞ্চলের জেলা ৫টি জেলা অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ১৯৯৬ সালে এ জেলায় প্রথম চা চাষের পরিকল্পপনা হাতে নেয়া হয়। ২০০০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ক্ষুদ্র পর্যায়ে চা চাষ। এ অঞ্চলে দিনদিন চা চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে তা আজ সিলেটের পর দ্বিতীয় অবস্থান পরিচিতি পেয়েছে। পঞ্চগড়ের চা শিল্পকে অনুসরণ করে ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারীতে চা উৎপাদনে সমৃদ্ধ করেছে রংপুরের পাঁচ জেলা। ২০২২ সালে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায় (পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী) চা উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি। যা বিগত বছরের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি উৎপাদনে সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।