ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু

গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু

গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বহু প্রতীক্ষিত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস শুরু হয়েছে। গত রোববার সন্ধ্যার দিকে তেল খালাসের জন্য বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কারের সঙ্গে পাইপলাইন যুক্ত করার মাধ্যমে তেল খালাস প্রক্রিয়া শুরু হয়। গতকাল সকাল থেকে পতেঙ্গায় অবস্থিত দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) স্টোরেজ ট্যাঙ্কে জ্বালানি তেল ভরা হচ্ছে। অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে ৮২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস করতে সর্বোচ্চ ৩২ ঘণ্টা থেকে ৩৫ ঘণ্টা লাগবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। যা আগে অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে ৯ থেকে ১১ দিন সময় লাগত। গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনে দ্রুত জ্বালানি তেল খালাসের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনন্য উচ্চতায় প্রবেশ করল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

জ্বালানি তেল খালাস প্রক্রিয়া শুরু উপলক্ষ্যে রোববার দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের বিশেষায়িত জাহাজ কাণ্ডারী-৩ যোগে সাংবাদিকদের গভীর সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, অনেক উন্নত দেশকে টেক্কা দিয়ে গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। সৌদি আরব থেকে আমদানি করা ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েলের পরীক্ষামূলক খালাস শুরু হয়েছে গভীর বঙ্গোপসাগরে। ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে এই তেল আসবে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ৮ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কারণে তেল খালাসের সিস্টেম লস ও খরচ কমার পাশাপাশি সময় ২৫ দিন কমে মাত্র ২ দিনে নেমে আসবে।

প্রকল্প সম্পর্কে জানা গেছে, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নে উপকূল থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) স্থাপন করা হয়েছে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোডিং করা হবে। ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাইপলাইন প্রথমে তেল নিয়ে আসা হবে কালারমারছড়ার সোনারপাড়া সিএসটিএফ বা পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাঙ্ক ফার্মে। পাইপলাইন কমিশনিং করার পর সেখানে থাকা হেজ, সার্কিট বাল্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এরপর স্টোরেজ থেকে বিভিন্ন পাম্পের মাধ্যমে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন পাড়ি দিয়ে তেল নিয়ে যাওয়া হবে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাঙ্কে।

ইস্টার্ন রিফাইনারির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনে ২০ হাজার টন ধারণক্ষমতা রয়েছে। এসপিএম থেকে মহেশখালীতে এসে যেখানে পাম্প হবে, সেখানে দুই লাখ টন ধারণক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল থাকবে এক লাখ ২৫ হাজার টন। বাকি ৭৫ হাজার টন হবে ডিজেল বা পরিশোধিত তেল। এই পাইপলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে তেলের সংরক্ষণ ক্ষমতাও বেড়েছে। বর্তমানে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৫ লাখ টন সংরক্ষণ ক্ষমতা আছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল সংরক্ষণ ক্ষমতা দুই লাখ ২৫ হাজার টন। বাকিটা পরিশোধিত তেল রাখার স্টোরেজ।

ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করা যায়। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন (এসপিএম) প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। ২০১৫ সালে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। মোট চার হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। এরইমধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে সাত হাজার ১২৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এর মধ্যে চার হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) এক হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ৬০১ কোটি টাকা দিচ্ছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্পের অধীনে এক সেট এসপিএম-পিএলইএম, একটি ভাসমান বয়া, ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন, এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উপকূল দিয়ে, দুই লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটারের ছয়টি স্টোরেজ ট্যাঙ্ক, তিনটি ব্লক ভাল্ব স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে।

বন্দর সূত্র জানায়, সৌদি আরব থেকে আসা বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কারটি ২২৯ মিটার লম্বা এবং সাড়ে ১২ মিটার ড্রাফটের। ট্যাঙ্কারটি গভীর সাগরে রেখে ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাঙ্গে নিয়ে আসা হচ্ছে। মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ ঘণ্টায় এই তেল খালাস শেষ করে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে ফিরতে পারবে ‘এমটি হোরে’ নামে পানামার পতাকাবাহী ট্যাঙ্কারটি। বর্তমানে পরিশোধিত (রিফাইন) এবং অপরিশোধিত (ক্রুড) মিলে বছরে ৬০ লাখ টনের বেশি জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়। এর পুরোটা আনা হয় সাগরপথে। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা জ্বালানি তেলবাহী বড় বড় অয়েল ট্যাঙ্কার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নিত। সেখান থেকে লাইটার ট্যাঙ্কারে করে তেল নিয়ে আসা হতো পতেঙ্গার গুপ্তাখাল প্রধান ডিপো এবং ইস্টার্ন রিফাইনারির ট্যাঙ্কে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রক্রিয়ায় বিপিসির কোটি কোটি টাকা খরচ হতো এবং দীর্ঘ সময় লাগত। লাইটারেজ করার সময় নানা কারণে অপচয়সহ বিপুল পরিমাণ তেল চুরি হতো। জ্বালানি তেল খালাসের মান্দাতার আমলের এই প্রক্রিয়ায় পরিবেশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। বিপিসির হিসেব মতে, মাদার ভ্যাসেল বসিয়ে রাখা এবং বিএসসির দুটি জাহাজ দিয়ে তেল লাইটারিং করতে বিপিসির বছরে খরচ হতো প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।

বন্দর সূত্র জানায়, সৌদি আরব থেকে ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল নিয়ে আসা এমটি হোরে ট্যাঙ্কার থেকে গত রোববার সকাল থেকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে বার্থিং করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েলের নেতৃত্বে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজটিকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় বার্থিং করানো হয়। এ সময় বন্দরের শক্তিশালী কয়েকটি টাগ জাহাজটিকে বার্থিংয়ে সহায়তা করে। রোববার বিকাল ৪টার দিকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে রশি দিয়ে তেলবাহী এমটি শোরে জাহাজটি আটকানো হয়। পরে মুরিং পয়েন্ট থেকে ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের সঙ্গে জাহাজটির পাইপের সংযোগ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময় বন্দরের টাগের পাশাপাশি একটি বিশেষায়িত বেসরকারি টাগও কাজে যোগ দেয়। কিছু কার্যক্রম শেষ করার পর জাহাজটির ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েল পাইপলাইনে সরবরাহে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। গতকাল পুরোদমে শুরু হয় তেল সরবরাহ।

বন্দর চেয়ারম্যান এ সময় সাংবাদিকদের প্রকল্পের নানা ইতিবাচক দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আজকের দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটি দিন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এই প্রকল্প সেই যাত্রাকে অনেক দূর এগিয়ে দিল। তিনি বলেন, প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি তেল পরিবহন এবং ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি ঘটবে। পরিবেশ, প্রতিবেশসহ নানা খাতে সুফল মিলবে। এই উদ্যোগের ফলে দেশের শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত