দেশে ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। একই সঙ্গে বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যাও। গত ৯ দিনের ব্যবধানে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৪৮ জন। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তে মৃত্যু বাড়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত্র হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। মৃত্যুও বাড়ছে।
দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ৯ দিনে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৪৮ জন। গত ১৭ জুন চারজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৪৭৭ জন, ১৮ জুন ১ জনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৩০৫ জন, ১৯ জুন দুইজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৩২৩ জন, ২১ জুন দুইজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৩৬০ জন, ২২ জুন একজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৩৬৯ জন, ২৫ জুন তিনজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৩৯৯ জন, ১ জুলাই তিনজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ২৭০ জন, ২ জুলাই দুইজনের মৃত্যুসহ আক্রান্ত ৫০৯ জন এবং গতকাল সোমবার চারজনের মৃত্যুসহ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩৬ জন। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের বছরগুলোর তুলনায় মারাত্মক হতে পারে। আর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জোর প্রস্তুতি নিতে হবে। এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভেরিয়েন্ট) ডেন-২-এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২-এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩-এ। আইইডিসিআর ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এ তথ্য জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধী কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিতে হবে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। এ বছরও ঢাকা শহরে রোগীর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যাচ্ছে, পাশাপাশি ঢাকার বাইরেও রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যার ফলে ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘ হচ্ছে। সাধারণ সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কথা থাকলেও গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়েছে। ঢাকায় বসতবাড়িতে এবার বর্ষ মৌসুমে এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা বেশি পেয়েছে। গত বর্ষা মৌসুমের তুলনায় ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেশি বাড়িতে লার্ভা পেয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার মশা জরিপ করে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘নিশ্চিত করেই বলতে পারি, গত বর্ষার ভরা মৌসুমে যত বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে, এবার তার চেয়ে বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেছে। জরিপে নির্মাণাধীন ভবন, বাড়ি, বহুতল ভবন, বেজমেন্ট, আধা পাকা বাড়ি ও বস্তি এলাকায় মশার উপস্থিতি জানার চেষ্টা করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জরিপকারীরা প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র, কোমল পানীয়ের বোতল, কলাপসিবল গেটের নিচের অংশ, ফেলে দেওয়া টায়ারের অংশ, দইয়ের ফেলে দেওয়া পাত্র, ছাদবাগানের ফুলের টব, পানির মিটারের কাছের গর্ত, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত কর্কশিট, সিরামিকের পাত্র, সিঁড়ির পাশের ভাঙা হাতল, যানবাহনের অংশ, গাড়ির গ্যারেজেসহ অনেক কিছুতেই লার্ভা পাচ্ছেন। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে বলা হচ্ছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। মৌসুম-পরবর্তী জরিপ, গত ৪ বছরের প্রথম ছয় মাসের আক্রান্তের সংখ্যা এবং গত ২২ বছরের আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪৩৬ জন। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগী বেড়ে দাঁড়াল ১ হাজার ৫৩১ জনে। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরো চারজনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত রোববার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৩৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৭৪ ও ঢাকার বাইরের ২৬২ জন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন নয় হাজার ১৯৩ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৬৫৫ জন। আর ঢাকার বাইরে অন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৫৩৮ জন। অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন সাত হাজার ৬০৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫ হাজার ৫৮৯ জন এবং ঢাকার বাইরের ২ হাজার ১৭ জন। একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে মারা গেছেন ৫৬ জন। উল্লেখ্য, দেশের ইতিহাসে বড় আকারে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ২০০০ সালে। ওই বছর ডেঙ্গুতে মারা যান ৯৩ জন। এরপর ডেঙ্গুর সবচেয়ে বড় প্রকোপ দেখা দেয় ২০১৯ সালে। ওই বছর মারা যান ১৭৯ জন। গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ এ সারাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।