চট্টগ্রামজুড়ে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগী

* মশা নিধনে চসিককে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের চিঠি * প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা

প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামিম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। নগরী ছাড়াও আশপাশের উপজেলাগুলোতেও ডেঙ্গুর দাপট সমানে চলছে। গেল ১০ বছর ধরে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু মশার দাপট বাড়ছে। বিশেষ করে ২০২০ ও ২১ সালে বেশি বাড়ে ডেঙ্গু মশা। এর আগে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও হঠাৎ বেড়েছে দাপট। চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে। আর জুনে গাণিতিক হারে বেড়ে যায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। চলতি বছরের ছয় মাসেই রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একমাত্র সমাধান এডিশ মশা নিয়ন্ত্রণ। চট্টগ্রাম নগরীতে গেল তিন বছর তেমন মশক নিধন কার্যক্রম চলেনি। বিশেষ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) জোরদার মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। পাশাপাশি নগরবাসীর মধ্যে বেড়েছে এডিশ মশার সম্পর্কে উদাসিনতা। যেখানে সেখানে পানি জমিয়ে রাখা ও বর্জ্য পরিষ্কার না করার কারণেও বাড়ছে এডিশ মশা। সেইসঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে। বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঝুঁকি। এরইমধ্যে মশক নিধনে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত তিন বছরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। চলতি বছরের ছয় মাসে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছেন অন্তত আটজন। যাদের মধ্যে গেল জুনেই মারা যান পাঁচজন। আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য বিভাগ। চিকিৎসকরা মনে করেন, বর্ষার শুরুতেই চলমান পরিস্থিতি আতঙ্কজনক। এখনই নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে এডিশ মশা ধ্বংসে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত চট্টগ্রামে মাত্র ১১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। ২০২১ সালে প্রথম ছয় মাসে কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। আর ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৬ জন। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৭০ জন। সে হিসেবে গত দুই বছরের ব্যবধানে ৩৪ গুণ বেশি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে কোনো রোগীর মৃত্যুর খবর না থাকলেও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তিনজন এবং চলতি মাসে পাঁচজনসহ আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, বেশিরভাগ রোগীই শেষ সময়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। যার কারণে তাদের শারীরিক জটিলতাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুতই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের। যেসব উপসর্গ থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে তা হচ্ছে হাড়ের জয়েন্টে ব্যথা কিংবা গা-হাত-পায়ে ব্যথা, প্রচণ্ড জ্বর, গায়ে র‌্যাশ, বমি আর মাথাব্যথা, এই সবক’টি উপসর্গ থাকলে বুঝতে হবে আপনার ডেঙ্গু হলেও হতে পারে। এছাড়াও ডেঙ্গুর আরো কিছু উপসর্গ রয়েছে যার মধ্যে মুখ আর নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ কিংবা প্রশ্রাবের সঙ্গে রক্তক্ষরণ, রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়া, শরীরের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হওয়া, চামড়ায় কালো কালো ছোপ দেখা দেয়া এবং পেটে অসম্ভব ব্যাথা হওয়াটাও ডেঙ্গুর লক্ষণ। চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রামে গেল বছর জুলাই থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছিল। আর এ বছর বেড়েছে জানুয়ারি থেকে। এবার সারা বছরই রয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। চলতি বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এরইমধ্যে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে মশা নিধনে তৎপর হওয়ার জন্য সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দিয়েছে জেলা সিভিল সার্জন।

চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, জেলায় ১ জানুয়ারি থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৩৯ জন। একই সময়ে গেল বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ২৫ জন। চলতি বছর জানুয়ারিতে ৭৭, ফেব্রুয়ারিতে ২২, মার্চে ১২, এপ্রিলে ১৮, মে মাসে ৫৩ ও জুনের ১৪ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৫৭ জন। এ সময় মারা গেছেন তিনজন। আক্রান্তদের মধ্যে নগরীতে ১৬২ ও উপজেলায় ৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১২১, মহিলা ৫১ ও শিশু ৬৭ জন। অপরদিকে, উপজেলা পর্যায়ে সীতাকুণ্ডে ৩৭, আনোয়ারা ও সাতকানিয়ায় পাঁচ, বাঁশখালী, রাউজান, হাটহাজারী, মিরসরাই ও কর্ণফুলীতে চার, লোহাগাড়া, পটিয়া, রাঙ্গুনিয়ায় ও সন্দ্বীপে দুই এবং চন্দনাইশ ও বোয়ালখালীতে একজন করে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।

মশা নিধনে ওষুধ ছিটানো নিয়ে নগরবাসীরও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশনের কোনো তৎপরতা নেই। মশার ওষুধ ছিটানো কার্যক্রমে সিটি কর্পোরেশনের গতি নেই। ৩-৪ মাস পর একজন স্প্রে ম্যানকে এলাকায় দেখা যায়। তারা কোনো রকম দায়সারাভাবে ওষুধ স্প্রে করে চলে যায়। নিয়মিত স্প্রে না করার কারণে নগরীতে মশার উৎপাত বেড়েছে। কয়েল জ্বালিয়েও মশা তাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। এডিশ মশা নিধন করলেই কেবল ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে।