ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নির্বাচনি বছরে আরপিও সংশোধন

সুশীল সমাজের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

সুশীল সমাজের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংসদে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বিলটি পাস হওয়ায় সুশীল সমাজের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ বলেছেন এর ফলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ক্ষমতা কমেছে, আবার কেউ বলছেন ক্ষমতা আগের মতো রয়েছে। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন আরপিও নিয়ে এখনই তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। সিইসি গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়া গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করব না। আরপিওর বিলের আইন গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়ার পরই সব প্রশ্নের উত্তর দেব।

তিনি বলেন, যে বিলটা পাস হয়েছে আমি অপেক্ষা করছি আইনটা হোক। এখনো আইন পাস হয়নি। বিল পাস হয়েছে। বিল এবং আইন এক নয়। বিল যেটি পাস হয়েছে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যদি সম্মতি প্রদান করেন তাহলে এটি আইন আকারে গেজেট হবে। তখনই বলা সমীচীন হবে। আইন আকারে প্রকাশের পর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বলব আমাদের অবস্থান।

৯১ এর ক ধারার প্রসঙ্গে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, এ মুহূর্তে আমি কোনো কথাই বলব না। একটু অপেক্ষা করেন। বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন কি না সেটা দুই একদিনের মধ্যেই জানতে পারব। তখন এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে।

সাংবাদিকদের উদ্দেশে সিইসি বলেন, বিল সম্পর্কে আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর আমি দেব, আগে আইনটা হতে দিন। তার আগে এ বিষয়ে কিছু বলব না।

এদিকে বরোধী দলের আপত্তি ও কঠোর সমালোচনা উপেক্ষা করে গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বহুল আলোচিত ‘রিপ্রেজেনটেশন অব পিপল (সংশোধনী) বিল-২০২৩’ পাস হয়েছে। বিলের পাসের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মো. ফখরুল ইমাম বলেছেন, বিলটি পাসের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন-ইসি’র ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। এই কমিশনের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। আর জনগণ নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চায় বলে দাবি করেছেন গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান।

বিলের ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠনোর প্রস্তাব দেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, গণফোরাম ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। ওই প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা নির্বাচন পরিচালনায় ইসির ক্ষমতা খর্ব, নির্বাচনে ঋণখেলাপিদের বিশেষ ছাড় প্রদানসহ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে এই বিলটি পাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন। তারা বিলটি পাসে আপত্তি জানালেও তাদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। পরে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়। সংসদে পাস হওয়া নির্বাচনি আইনটিতে প্রস্তাবিত সংশোধনে ৯১ (ক) অনুচ্ছেদে একটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। আগে বিলের ৯১(এ) ধারায় ছিল, নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয়, নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোটগ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। এর সঙ্গে যুক্ত করে নতুন উপধারায় বলা হয়েছে, শুধু কয়েকটি কেন্দ্রের গোলযোগ-জবরদস্তির জন্য পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা যাবে না। যেসব কেন্দ্রের ভোট গ্রহণে অভিযোগ নেই, তা স্থগিত করা যাবে না। এতে ইসির ক্ষমতা খর্ব হয়েছে বলে বিরোধী দলের সদস্যরা দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগ, গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইসির নির্বাচন বন্ধের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিলটি পাসের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, বিলটি পাসের মাধ্যমে ইসি পুরো নির্বাচনি এলাকা বন্ধ করতে পারবে না, এমন বিধান করা হচ্ছে। বিলটি পাস হলে শুধু কেন্দ্রগুলো যেখানে গ-গোল হয়েছে, সেখানে বন্ধ করতে পারবে। এটা ইসির স্বাধীতায় হস্তক্ষেপ। কারণ, ইসি যদি মনে করে কোনো আসনে অনেক গ-গোল হবে, পরিবেশ খারাপ আছে, তাহলে তারা সেখানে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে। গত ৫২ বছর সেটাই চলে আসছে। এখন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করে কীভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে? সরকারের আজ্ঞাবহ এই কমিশনের অধীনে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব না। এই আলোচনায় অংশ নিয়ে গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধনের বিলটি আনা হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য বিলটি আনা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে আইন করা হয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে। যে কারণে প্রত্যেকটা জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীনরা আরপিওর কিছু সংশোধন করে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করার জন্য আরপিও সংশোধনের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলো নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিরোধী দলের বক্তব্য সঠিক নয় বলে দাবি করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, জোর জবরদস্তি, গোলযোগ, সহিংসতায় তদন্তসাপেক্ষে পুরো নির্বাচনি এলাকার ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। তবে একটি কেন্দ্রে গ-গোলের কারণে পুরো আসনে নির্বাচন বন্ধে মানুষের অধিকার লঙ্ঘন হয়। তাই বিষয়টি স্পষ্ট করতে আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে, যাতে যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে সেগুলো বন্ধ করতে পারবে। একই আসনের যেখানে সঠিক নির্বাচন হয়েছে, তা বন্ধ করার ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়নি। এটাকে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়নি, বরং ইসিকে শক্তিশালী করা হয়েছে। পাস হওয়া বিলে টিআইএন এবং ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের কপি জমা, প্রার্থিতা বাছাইয়ে বৈধ হলেও তার বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ, দল নিবন্ধনে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বের প্রতিশ্রুত লক্ষ্যমাত্রা ২০২০ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সাল করা এবং ভোটের সংবাদ সংগ্রহে থাকা গণমাধ্যমকর্মীদের কাজে বাধা দিলে কিংবা যন্ত্রপাতি বিনষ্ট করলে শাস্তি-সাজার বিধান রাখা হয়েছে। এদিকে বিশিষ্টজনরা বলেছেন, এবার জাতীয় নির্বাচন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আরপিওতে সংশোধন কমিশনকে কতটা দুর্বল করে তুলছে, তা পরিষ্কার হয়ে যাবে ভোটের সময়েই। এসব বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সংশোধনের পরও, আরপিওতে অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। আরপিও’র ধারা অনুযায়ী কমিশনের পরীক্ষিত ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে, সেটা বলা যায়। সরকার প্রতিনিয়ত যেখানে দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আসছে, সেখানে বিদ্যমান আইনকে হালকা করা কতটা যৌক্তিক? অপর দিকে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এবারের নির্বাচন ভালো না হলে অথবা পরিচালনায় ব্যর্থ হলে তার সিংহভাগ দায় বর্তাবে কমিশনের ওপর। সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, (আরপিও) বিলটি পাস হওয়ায় ইসির ক্ষমতা যে খর্ব হয়েছে, তা স্পষ্ট। তিনি বলেন, ইসি একেক সময় একেকটি কথা বলে। তারা এমনি দুর্বল, এখন আইন পাস হওয়ায় আরো দুর্বল হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত