ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মশক নিধনে অনিহার খেসারত

ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু আতঙ্ক

ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু আতঙ্ক

বছরের অনেকটা সময়জুড়ে এডিস মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। অথচ এই এডিস মশা নিধনে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাসহ সেবা সংস্থাগুলোর বছরব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে প্রত্যেক বছরে এডিস মশার কামড়ে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের প্রত্যেকটি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় যাদের মশক নিধন কার্যক্রম জোরাল করা দরকার তাদের কাজের অনিহা দেখা যায়। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির কোণা ও ফাঁকা জায়গায় নারিকেলের খোসায় জমানো পানিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। নির্মাণাধীন ভবন, বাড়ি, বহুতল ভবন, বেজমেন্ট, আধা পাকা বাড়ি ও বস্তি এলাকায় জমা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জরিপকারীরা প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র, কোমল পানীয়ের বোতল, কলাপসিবল গেটের নিচের অংশ, ফেলে দেওয়া টায়ারের অংশ, দইয়ের ফেলে দেওয়া পাত্র, ছাদবাগানের ফুলের টব, পানির মিটারের কাছের গর্ত, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত কর্কশিট, সিরামিকের পাত্র, সিঁড়ির পাশের ভাঙা হাতল, যানবাহনের অংশ, গাড়ির গ্যারেজেসহ অনেক কিছুতেই এডিসের লার্ভা পাচ্ছে। ডেঙ্গু প্রকোপ বাড়ার বিষয়ে বলা হচ্ছে, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক।

সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে জানতে পারলেন মশা দমনে তাদের পদ্ধতি ভুল ছিল। সঙ্গে অর্থেরও অপচয় হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি উত্তর সিটি করপোরেশন। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় বৃষ্টিতে স্বচ্ছ পানি জমতে শুরু করেছে। জমে থাকা এই স্বচ্ছ পানিতেই ডিম ছাড়ে এডিস মশা। কিন্তু মশা নিধনে কার্যত ঠিকভাবে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় বেড়েছে এডিসের প্রকোপ। আগামী মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।

এদিকে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫৮৪ জন। এ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগী বেড়ে দাঁড়াল ১ হাজার ৯১১ জনে। এ সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে গত বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৮৪ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৮২ ও ঢাকার বাইরের ২০২ জন।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০ হাজার ৪৫৫ জন। এদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সাত হাজার ৪৬৬ জন। আর ঢাকার বাইরের অন্য বিভাগে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৯৮৯ জন।

অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন আট হাজার ৪৮২ জন। এদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬ হাজার ১৩২ জন এবং ঢাকার বাইরে ২ হাজার ৩৫০ জন। আর এ সময়ে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৬২ জন।

এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আলোকিত বলেন, আমরা আগেই থেকেই বলে আসছি এ দেশে সমন্বিত বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা প্রয়োগ না করলে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ফগার মেশিনে ওষুধ ছিঁটালে এক জায়গার মশা অন্য জায়গায় উড়ে যায়। এক্ষেত্রে ফগারে মশা নিধন ওষুধ ছিঁটিয়ে খুব একটা লাভ হয় না।

তিনি আরো বলেন, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর সর্বোচ্চ মাত্রায় ডেঙ্গুর আক্রমণ লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রতিদিন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ। ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। কোনোভাবেই এডিস মশা ঠেকানো যাচ্ছে না।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম চালিতে যেতে পারলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। আমরা জানি এডিস মশার জন্ম হয় বিভিন্ন পাত্রে বা বাড়ির কোনায় জমে থাকা পানিতে। নাগরিকরা যদি সচেতন হতেন, নাগরিকরা যদি সম্পৃক্ত হতেন, তারা যদি নিশ্চিত করতেন যে তাদের বাড়ির আঙিনায় কোনো পাত্রেই পানি জমে থাকবে না যেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে, তাহলে হয়তো এই প্রকোপ কম থাকত। এজন্য আমি বলব, নগরবাসীর সচেতনতা এবং সিটি করপোরেশনের বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া জরুরি। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

এ ব্যাপারে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এডিস মশা নিধনে ওষুধের চেয়ে বাসাবাড়ির আঙ্গিনা-কোণা এবং ফাঁকা জায়গায় পরিষ্কার রাখা। একই সঙ্গে সরকারের সেবা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি এডিস মশা নিধনে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। পরিবেশ-পরিচ্ছন্ন ও মশামুক্ত করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের শহর আমাদের পরিষ্কার রাখতে হবে। সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি করপোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে, ঠিক তেমনি নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়ও কম নেই।

তিনি আরো বলেন, পাড়া-মহল্লায় তরুণরা দল বেঁধে নিজেরাই নেমে পড়তে হবে আমাদের নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে। আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সেজন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেকেই সাবধান থাকতে হবে। সাবধানের মার নেই। মশা নিয়ন্ত্রণ কৌশলে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কিন্তু যেসব সংস্থা মশা নিধন কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে, সেই সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষকে এডিস নিধনে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। এটি ওই সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা।

প্রসঙ্গত, গত বছরে (২০২২ সালে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় একাধিকবার ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছে। ক্রাশ প্রোগ্রামের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিন দিন ডেঙ্গু নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হবে। এছাড়া জুন থেকে প্রতিনিয়ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। ডিএসসিসিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি এ কর্মকর্তার।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গু নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলো থেকে ডেঙ্গু রোগীদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে অভিযান চালানো হচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এডিস মশা নিধন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত