দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার ১৩ জুলাই উদ্বোধন

দূষণরোধে বাঁচবে নদী

পয়ঃবর্জ্য শোধনে বালু নদের দূষণ কমছে, বিদ্যুৎও সাশ্রয় হচ্ছে

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ঢাকা ওয়াসার দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধন এবং পাগলা পয়ঃশোধনাগার পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে আগামী ১৩ জুলাই। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বলে জানান ঢাকা ওয়াসার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

তারা বলছেন, দাশেরকান্দি ও পাগলা পয়ঃশোধনাগার সম্প্রসারণের ভিত্তিপ্রস্তর অনুষ্ঠানটি শেরে বাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। সম্মানিত অতিথি হিসেবে থাকবেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহম্মদ ইব্রাহিম। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।

ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকায় প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস। এত মানুষের সেবায় নিয়োজিত ৫৬টি সেবা সংস্থা। ঘনবসতিপূর্ণ এই শহরে সেবা দিতে গিয়ে বহু সংস্থা যেখানে ন্যুয়ে পড়েছে, সেখানে প্রতিনিয়ত নগরবাসীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সেবা সংস্থা ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটি সুপেয় পানি সরবরাহের পাশাপাশি স্যুয়ারেজেও আধুনিকায়নের ছোঁয়া লাগিয়েছে। রাজধানীর আফতাবনগর সংলগ্ন দাশেরকান্দিতে পয়ঃশোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষে এখন পূর্ণ সক্ষমতায় চলছে দাশেরকান্দি। এতে ঢাকা মহানগরের চারপাশে নদীগুলোর দূষণ কমছে। অথচ এই পয়ঃশোধনাগার নিয়ে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এক সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। এতে বলা হয় সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনের ময়লা পানি পরিষ্কার করা কোনোভাবেই এই প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এএম মোস্তফা তারেক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার উদ্বোধনের আগমুহূর্তে এমন সংবাদ সম্মেলন উদ্দেশ্যমূলক। যারা এ সংবাদ সম্মেলনের সঙ্গে জড়িত, তারা দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার নিয়ে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভুয়া তথ্য দিয়েছেন।

সরেজমিন দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার ঘুরে দেখা গেছে, প্রকল্পের অধীনে রামপুরা সেতুর পশ্চিম পাশে বর্জ্য লিফটিং স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া হাতিরঝিল থেকে আফতাবনগর হয়ে দাশেরকান্দি শোধনাগার পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার ট্রাংক স্যুয়ারেজ লাইন (পয়ঃবর্জ্য পরিবহণের প্রধান লাইন) রয়েছে। দাশেরকান্দিতে প্রায় ২৪ হেক্টর জমির ওপর এই শোধনাগার নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে বিশাল আয়তনের ১২টি গোলাকার ট্যাংক রয়েছে। পয়ঃবর্জ্য কয়েক দফা শোধনের পর পানি বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। এই শোধনাগারের মাধ্যমে হাতিরঝিলের দক্ষিণে ছয়টি এবং উত্তরে পাঁচটি স্পেশাল স্যুয়ারেজ ডাইভারশন স্ট্রাকচার (এসএসডিএস) দিয়ে নির্গত বর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। পয়ঃশোধনে প্রতিদিন প্রায় ৫৮০ টন প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতাসহ একটি স্লাজ শুকানোর-বার্নিং সিস্টেম করা হচ্ছে।

জানা গেছে, এতদিন পয়ঃবর্জ্য শোধনের ব্যবস্থা না থাকায় নগরের সব পয়ঃবর্জ্য ড্রেন, নালা, খাল ও ঝিল গড়িয়ে ঢাকার চারপাশের নদীতে পড়ত। এতে ভয়াবহ আকারে পৌঁছায় নদীর পানিদূষণ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার স্থাপন করে ঢাকা ওয়াসা। রমনা থানার অন্তর্ভুক্ত এলাকা মগবাজার ওয়্যারলেস রোড, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মৌচাক, আউটার সার্কুলার রোড, মহানগর হাউজিং, কলাবাগান ও ধানমন্ডির (পূর্বাংশ) পয়ঃবর্জ্য শোধন করা হচ্ছে। এছাড়া হাতিরঝিলের উত্তর পাশের এলাকা তেজগাঁও, নাখালপাড়া, নিকেতন, বাড্ডা, বনানী ও গুলশানের আংশিকসহ রাজধানীর বেশ কিছু এলাকার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করে দুর্গন্ধমুক্ত পানি বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দিনে ৫০ কোটি লিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন করা হয়। আর এর সুফল পাচ্ছে নগরীর ৫০ লাখ মানুষ।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটি বাংলাদেশের প্রথম এবং বৃহত্তম আধুনিক পয়ঃশোধন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। এটি দক্ষিণ এশিয়ারও একক বৃহত্তম পয়ঃশোধনাগার। চীনে পয়ঃশোধন ও স্লাজ (কাঁদাযুক্ত) আলাদা করতে দুটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট চালু রাখতে হয়। সেখানে দাশেরকান্দি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পয়ঃশোধন ও স্লাজ আলাদা করা যাচ্ছে।

তারা আরো বলেন, দাশেরকান্দি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পয়ঃশোধনের পর পানি বেগুনবাড়ী খাল ও বালু নদী হয়ে শীতলক্ষ্যা পড়ছে। ফলে এ ডাউন স্ট্রিমে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির গুণগত মান ভালো পাওয়া যাচ্ছে। এতে বছরে এক মাস শীতলক্ষ্যার পানি প্রি-ট্রিটমেন্ট ছাড়াই ঢাকা ওয়াসা সরবরাহ করছে। ফলে বিদ্যুৎ বিল বাবদ ওয়াসার প্রায় ২৭ লাখ টাকা সাশ্রয় হয়।

ঢাকার পয়ঃবর্জ্য পরিস্থিতি বদলাতে ২০১৫ সালের আগস্টে দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পটির আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এটি হাতিরঝিল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে আফতাবনগরের কাছে দাশেরকান্দিতে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম পয়ঃশোধনাগার প্রকল্প। দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক বিশালাকার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট। চীনের ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পেটেন্টের অধীনে প্রস্তুত করা হয়েছে।

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মহসিন আলী মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বালু নদীর পাশাপাশি শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণের পরিমাণও কমবে। এছাড়া এই শোধনাগারে প্রতিদিন যে শুষ্ক বর্জ্য তৈরি হবে, সেই বর্জ্য সিমেন্ট কারখানায় ব্যবহার করা যাবে কাঁচামাল হিসেবে। এতে নগরের পরিবেশ আরো ভালো হবে।

প্রসঙ্গত, ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট হাতে নেওয়া হয়। ঢাকা শহরকে শতভাগ স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা এবং পয়ঃবর্জ্য শোধন করে পানি নদীতে ফেলার জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।