অরক্ষিত সড়ক

ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনে আতঙ্কিত যাত্রা

প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের পীরগঞ্জে গতকাল দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাবা-ছেলে নিহত হন। এতে আহত হন অন্তত ৩০ জন। এর আগে গত ৭ জুলাই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। এতে আহত হন অন্তত ২০ জন। গাড়ি মাত্রাতিরিক্ত গতিতে চালানো হচ্ছিল বলেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানায় স্থানীয়রা। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন সংঘর্ষে প্রতিনিয়ত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।

প্রত্যেক বছরের মতো এবারো সারা দেশে ঈদুল আজহার ছুটিতে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত এবং ৫৪৪ আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার ঢাকায় বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী জানান, তাদের সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল প্রতি বছরের মতো এবারো প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২২ জুন থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ৬ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন নিহত এবং ৫৪৪ জন আহত হয়েছেন। গত ২০২২ সালের ঈদুল আজহায় যাতায়াতের সঙ্গে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ১৫ দশমিক ১৬ শতাংশ, প্রাণহানি ৩৩ দশমিক ১১ শতাংশ, আহত ৪২ দশমিক ২৭ শতাংশ কমেছে। এ সময় রেলপথে ২৫টি ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ১০টি দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত, আহত ১৫ জন ও ছয়জন নিখোঁজ হয়েছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক বছর ধরে দুর্ঘটনার শীর্ষে মোটরসাইকেলের অবস্থান থাকলেও এবারের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পশুবাহী যানবাহনের ব্যাপক চলাচল ও ঈদযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যানের অবাধ চলাচলের কারণে ট্রাক-পিকআপ-কভার্ডভ্যান সড়ক দুর্ঘটনার শীর্ষে। ৮৮টি ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনায় ৯৩ জন নিহত এবং ১৯৩ জন আহত হয়েছেন। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, নিহতের ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ এবং আহতের ৩৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ প্রায়। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ৯১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৯৪ জন নিহত ও ৭৭ জন আহত হন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ, মোট নিহতের ৩১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, মোট আহতের ১৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। এ সময় সড়কে দুর্ঘটনায় ৮২ জন চালক, ৯ জন পরিবহন শ্রমিক, ৩৫ জন পথচারী, ৪৭ জন নারী, ২৫ জন শিশু, ১৭ জন শিক্ষার্থী, পাঁচজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য (এক পুলিশ, এক নৌবাহিনী, এক র‌্যাব, এক বিজিবি, এক সেনাবাহিনী), চারজন শিক্ষক, পাঁচজন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী নিহত হওয়ার পরিচয় মিলেছে।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বেসরকারি সংগঠনগুলো কাজ করায় আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সচেতনতা বেড়েছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান নিয়মিত প্রকাশ করার বিষয়টি। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম দায়ী অবৈধ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ে কেউ সেভাবে কাজ করছে না। ফলে এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো তথ্যই মিলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে তথ্য বিভ্রান্তির দায় মূলত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। বেসরকারি সংগঠনগুলোর দায়ের চেয়ে সীমাবদ্ধতা বেশি বিদ্যমান।

চলতি বছরের ১ জুন বিআরটিএর ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী, মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৩টি। যা ২০১০ সালে ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি। ফলে গত এক যুগে (২০১০-২২) নিবন্ধিত যানবাহন বেড়েছে ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৯৫টি। এর মধ্যে ৫-৬ লাখের বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে রঙ করে আবার নামানো হয় সড়কে। ফিটনেস সনদ হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিত করছেন না বাস মালিকরা।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, চাঁদাবাজি, অনৈতিক অর্থ লেনদেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে সড়কে আনফিট গাড়ি চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। পদে পদে পুলিশের হয়রানিও একটি বড় বাধা। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা মহলকে ম্যানেজ করে চলেন মালিকরা। সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে প্রাণহানি ঘটছে।

বিআরটিএর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে তারা সারা বছরই তৎপর থাকেন। নিয়মিত অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে পরিবহন মালিকদের কারণেই মূলত ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমছে না।

সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা (ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা) বসানোর কাজে বেশ কিছু পরিবর্তন আনছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। হাইওয়ে পুলিশ এরইমধ্যে সংশোধিত প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। জানা গেছে, যাত্রীদের নিরাপত্তার পাশাপাশি বেপরোয়া গতি ঠেকাতে ‘অটোমেটিক ডিটেকশন ব্যবস্থা’ চালু করার সুপারিশ করেছে হাইওয়ে পুলিশ। এ ব্যবস্থায় বেপরোয়া গতির গাড়িগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মামলার আওতায় চলে আসবে। এমনকি দায়ের করা মামলার তথ্য গাড়ির মালিকের মোবাইল ফোনে চলে যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তাবনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কাজ করবে হাইওয়ে পুলিশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সিসিটিভি প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এখন প্রকল্প সংশোধনের কাজ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ‘ডিজিটাল অটোফাইন সিস্টেম’ নামে একটি অ্যাপ এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। নির্ধারিত গতিসীমার বেশি গতিতে, অর্থাৎ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে, সেই গাড়ির বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জরিমানা বা মামলা হবে।

হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, পাইলট প্রকল্পের আওতায় সিসিটিভি স্থাপন করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে গাড়ির বেপরোয়া গতি, কিংবা ডাকাতির মতো ঘটনা অনেকটাই কমে যাবে। নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি গতিতে কেউ গাড়ি চালালে, সড়কে বসানো ডিটেক্টেড মেশিনের মাধ্যমে ওই গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে। একইসঙ্গে মামলার বিষয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির মালিকের কাছে এসএমএস চলে যাবে।

সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশ করেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এর মধ্যে আছে মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের মতো ছোট যানবাহনের আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা। দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে যানবাহনের ফিটনেস প্রদান, ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা, সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করতে হলে সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে ট্রাফিক আইন প্রয়োগ করতে হবে। ঈদের তিন দিন আগে থেকে জাতীয় মহাসড়কে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।