ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় সংসদ নির্বাচনি বছর

ডিসি-এসপি পদে রদবদল শুরু

ডিসি-এসপি পদে রদবদল শুরু

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক মহল ও গোয়েন্দা সংস্থাদের তৎপরতা ততই বাড়ছে। কেন না বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এবারের নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ফলে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষক ও কূটনৈতিক সূত্রগুলো মনে করছে, দ্বাদশ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সম্প্রতি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিএনপির প্রতিনিধি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। এছাড়া ভোটের আগেই মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন সাজানো শুরু হয়েছে। প্রথম দফায় গত ২ জুলাই ময়মনসিংহ ও বরিশালের বিভাগীয় কমিশনারের পর রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনারসহ দেশের ১০ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ দিয়েছে সরকার।

গত বৃহস্পতিবার ১০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জেলাগুলো হলো ঢাকা, রাঙামাটি, বান্দরবান, টাঙ্গাইল, পাবনা, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও গাজীপুর। নতুন ডিসিদের মধ্যে সাতজন বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। জেলা পর্যায়ে ডিসি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসিরা জেলার সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং কালেক্টর হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়গুলো দেখে থাকেন। এছাড়া নির্বাচিত সরকারের বিশেষ কর্মসূচি ও চলমান সব উন্নয়নমূলক কাজে জেলা প্রশাসক তদারকি করে থাকেন। নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ কিংবা আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের সময় জেলা প্রশাসকেরা (ডিসি) জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকায় যেকোনো কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও তাঁদের থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা। সেদিক থেকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে ডিসিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবেন। আরো বেশকিছু ডিসির রদবদলের সম্ভবনা রয়েছে। এছাড়া গত ১৪ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে তিনটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে সাতজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও ২২ জন পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়। ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশ প্রশাসনে এটি বড় ধরনের বদলি।

বিশ্লেষক বলেছেন, জনপ্রশাসনে রদবদল ছাড়াও জঙ্গিবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ধর্মীয় উসকানি দিয়ে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারেন তাদেরও নজরে রাখা হয়েছে। গত ১২ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর তৎপরতার কারণে জঙ্গিরা কিছুটা দুর্বল হলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। হয়তো নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে তারা, নতুন করে নাশকতার ছক আঁটছে। এবারের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন থেকেই রাজনীতির মাঠ গরম হতে শুরু করেছে। অতীতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক উত্তাপ যখন তীব্র হয় তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জঙ্গিবাদ। এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না, সে আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতির মাঠে যখন প্রধান দুই রাজনৈতিক দল উত্তাপ ছড়াচ্ছে, সেই অবসরে বাংলাদেশে নতুন করে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে।

চলতি বছরের ৯ মে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-৯ এর যৌথ অভিযানে সিলেটের এয়ারপোর্ট থানার বড়শালা বাজার এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার’ শূরা সদস্য ও দাওয়াতি শাখার প্রধানসহ চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন সংগঠনটির দাওয়াতি শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিন (৩৪), মো. আবু জাফর ওরফে জাফর তাহান (৪০), মো. আক্তার কাজী ওরফে সাইদ (৩৮) ও সালাউদ্দিন রাজ্জাক মোল্লা (৩২)। তাদের মধ্যে মুমিন সিলেটের দক্ষিণ সুরমা, তাহান ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন, সাইদ চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও সালাউদ্দিন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বাসিন্দা।

সিলেটে র‌্যাব-৯ সদরদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অভিযানের সময় নগদ ২ লাখ টাকা, ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস এবং গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করা হয়।

আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য দলের নেতাকর্মীদের যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত ৫ জুন গণভবনে আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বহুমুখী ষড়যন্ত্রের কারণে নির্বাচন একটি চ্যালেঞ্জ হবে। যখনই দেশের মানুষের জীবনযাত্রার কিছুটা উন্নতি হয়, তখনই বাংলাদেশে কিছু কুলাঙ্গার আছে, যারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং সর্বত্র মিথ্যাচার করে। কিছু মানুষ আন্তর্জাতিক অনুদান পাওয়ার জন্য বিদেশিদের সামনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে।

অন্যদিকে গত ২২ জুন বৃহস্পতিবার বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন যে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে যারা বিগত সংসদ নির্বাচন করেছেন এবং ভবিষ্যতে নির্বাচন করবেন, এমন নেতাদের গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তবে বিএনপি মহাসচিবের এসব অভিযোগকে অসত্য ও ভিত্তিহীন বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, এ অভিযোগের ব্যাপারে তারা (বিএনপি) কোনো প্রমাণ দিতে পারবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিএনপির কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা বা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে গোয়েন্দা সংস্থা সে ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দেয়। সেই তথ্যের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক বা গ্রেপ্তার করে থাকে। এর বাইরে কাউকে তুলে নেওয়ার কোনো ঘটনা ঘটার সুযোগ নেই।

গত ৬ মার্চ সোমবার সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলাপকালে জনপ্রিয়তা যাচাই করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, একটি সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের ভেতরের ভালো-খারাপ, কে ভালো, কে খারাপ, কে গ্রহণযোগ্য, কে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে, কে অপকর্ম করছে; এসব রিপোর্ট করার দায়িত্ব তাদের। প্রতি ৬ মাসে আমরা একটি জরিপ প্রধানমন্ত্রী নিজে করান। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা করছে, প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিশেষজ্ঞদের দিয়ে জরিপ করাচ্ছেন। এখন প্রতি ৩ মাসে এই জরিপ হচ্ছে। আর আমাদের নিজস্ব উপায়ে সাংগঠনিকভাবে, দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছ থেকে আমরা ফিডব্যাক পাচ্ছি। আমাদের সিদ্ধান্ত, জনগণের কাছের অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে আমরা মনোনয়ন দেব। প্রার্থী অনেকেই হতে পারে।

ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার নজরদারি করে হালনাগাদ প্রতিবেদন তৈরি করছে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) কোর সাইবার টাস্কফোর্স (সিসিটিএফ) টিম। গত ৬ জুলাই নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ তথ্য জানায় এনটিএমসি। এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো মহল যেন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে কমিটি প্রধান সংশ্লিষ্ট সবাইকে চোখ-কান খোলা রেখে সতর্ক থাকতে বলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে যেন দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, তা কঠোরভাবে দেখতে বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম ও তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বাইরে থেকে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে উসকানিমূলক বক্তব্য। বেড়েছে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। এসব দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি অর্থ সহায়তাকারী ও পৃষ্ঠপোষকদের তথ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বৈঠকে জানানো হয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল যেন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখাসহ গোয়েন্দা নজরদারি করা হয়েছে এবং তা নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত