চট্টগ্রাম নগরীতে ‘ডেঙ্গু মশার’ ৪৯০ হটস্পট

* স্প্রে না করায় চসিকের ৯ কর্মীকে শোকজ * দিনে কামড়ায় এডিশ মশা, গবেষণায় তথ্য

প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে ‘ডেঙ্গু’ আতঙ্কে দিন পার করছেন নগরবাসী। দিন যতই যাচ্ছে ক্রমশ তা ভযাবহ রূপ নিচ্ছে। নগরীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায় অন্যান্য রোগীর তুলনায় ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ছোট শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষ সবাই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হলো এডিস জাতের মশা। এ ভাইরাসবাহী মশার কামড়ে ডেঙ্গুর জীবাণু একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এই মশা কখন কামড়ায় এ নিয়ে অনেকেরই নানা মত আছে। এতদিন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল এই মশাটি মূলত দিনের বেলা কামড়ায়। সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচার প্রচারণায়ও দিনের বেলা মশারির ভেতরে থাকতে অথবা ফুলহাতা কাপড় পড়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই মশাটি শুধু দিনে নয়, বরং রাতেও কামড়ায়। এর অর্থ মশাটির আচরণে পরিবর্তন ঘটেছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। জরুরি পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া এ অবস্থান থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।

জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধি দল নগরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি স্থান চিহ্নিত করে তা চসিককে অবহিত করে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে হালিশহর, আগ্রাবাদ, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকা, ডবলমুরিং এবং বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা। এছাড়া একই বিভাগের শুরুতে পরিচালিত মশা জরিপে দেখা গেছে, নগরে মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে চসিকের উদ্যোগে ২০২১ সালে গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নগরের ৯৯টি স্থান পরিদর্শন করে ৫৭টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৩৩ স্থানে এডিস, ৩৯ স্থানে এনোফিলিস ও ২২ স্থানে এডিস ও এনোফিলিস দুটোই পাওয়া গেছে। তবে ১৮ স্থানে এডিস ও ১২ স্থানে এনোফিলিস পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১৫ স্থানে শতভাগ এডিস ও দুই স্থানে শতভাগ এনোফিলিস পাওয়া গেছে। পাঁচলাইশসহ পাঁচ ওয়ার্ড ব্রিডিং পয়েন্ট মুক্ত চসিকের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ বিভাগের জরিপ। নগরীতে সর্বোচ্চ ৫২টি মশার প্রজননস্থল রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশসের (চসিক) ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডটিসহ পুরো শহরে এমন হটস্পট রয়েছে ৪৩৩টি। চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে এসব স্পট চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে এমন এলাকাগুলোকে ভিত্তি করে আরো ৫৭টি হটস্পট চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বিবেচনায় নগরে ৪৯০টি হটস্পট রয়েছে।

বিষয়টি নিশ্চিত করেন চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহী। তিনি বলেন, মশার প্রজননস্থলগুলোর মধ্যে অনাবাদি জমি, নালা ও ঝোঁপঝাড়, ডোবা, খাল, পুকুর, জলাশয়, পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে। হটস্পটগুলোতে কীটনাশক ছিটানোর ওপর জোর দিচ্ছি। জরিপের তথ্য অনুযায়ী হটস্পটগুলো হলো, ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলি ওয়ার্ডে ২৫টি, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে ১৫টি, ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে ১৫টি, ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডে ৫২টি, ৬ নম্বর পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে ২৯টি, ৭ নম্বর পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডে ১৭টি, ৮ নম্বর শোলকবহর ওয়ার্ডে ৩০টি, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলি ওয়ার্ডে ১৩টি, ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ছয়টি, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে ১৬টি, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে ১২টি, ১৩ নম্বর পাহাড়তলি ওয়ার্ডে তিনটি, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে সাতটি, ১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ডে পাঁচটি, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ডে ৯টি, ১৭ নম্বর পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে সাতটি, ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে ১৩টি, ২০ নম্বর দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডে ১২টি, ২১ নম্বর জামালখান ওয়ার্ডে ১৪টি, ২২ নম্বর এনায়েত বাজার ওয়ার্ডে সাতটি, ২৩ নম্বর উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আটটি, ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে দুটি, ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডে ১২টি, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে ১০টি, ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে ১২টি, ২৯ নম্বর পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে ১৬টি, ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে ৮টি, ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে তিনটি, ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৪ নম্বর পাথরঘাটা ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৫ নম্বর বঙিরহাট ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৭ নম্বর মুনিরনগর ওয়ার্ডে পাঁচটি, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে একটি, ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে ১৪টি, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে ১৬টি এবং ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে চারটি মশার প্রজনস্থল রয়েছে। তবে ৩ নম্বর পাঁচলাইশ ওয়ার্ড, ১৯ নম্বর দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ড, ৩৪ নম্বর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড এবং ৩৬ নম্বর গোসাইলডাঙা ওয়ার্ডে কোনো ব্রিডিং পয়েন্ট নেই বলে জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পর মশক নিধনে জুন মাসে দুই দফা ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। সর্বশেষ ২২ জুন শুরু হওয়া কর্মসূচির ১৫ দিন পেরিয়েছে। এরপরও মশা নিয়ন্ত্রণে না আসার অভিযোগ করেছেন নগরবাসী।

প্রসঙ্গত, এডিস মশা মানুষকে কেবল দিনের বেলায় কামড়ায় কি না এমন ধারণা যাচাই করতে গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা পরিচালনার কথা জানান কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। এটি পরীক্ষার জন্য তিনি একজন মানুষকে মশারির ভিতরে রাখেন, তখন বাইরে তাকে কামড়াতে আসা মশাগুলোকে জীবিত ধরে ধরে একটি কাপে সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেই মশাগুলোকে পরীক্ষাগারে এনে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে মাইক্রোস্কোপের নিচে পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, এগুলো কোন প্রজাতির মশা। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মৌসুমে টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে এ মশা সংগ্রহ ও আচরণ পরীক্ষার কাজ করেছেন তিনি। তারা মূলত দেখতে চেয়েছিলেন কোন ধরনের মশা কোন সময়ে কামড়াতে বেশি পছন্দ করে। পরীক্ষায় তারা এসব মশার কামড়ানোর ছন্দ, কামড়ানোর সময় বা কর্মকাণ্ডের ধরন একেক রকম দেখেন। এই পরীক্ষা করতে গিয়েই অধ্যাপক বাশার জানতে পেরেছেন যে, এডিস মশা দিনের বেলা যেভাবে কামড়ায়, তেমনি রাতেও কামড়ায়। তবে রাতের বেলায় কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে বলে তিন জানান। সম্প্রতি তিনি রাতের বেলায় তার শরীরে বসা মশার প্রজাতি পরীক্ষা করে এডিস মশার উপস্থিতি পেয়েছেন। এতে তিনি ধারণা করছেন, এক সময় এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ালেও এখন এই মশার বৈশিষ্ট্য বা আচরণগত পরিবর্তন এসেছে। বাশার বলেন, এর আগে আমরা জানতাম এডিস মশা শুধুমাত্র দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং বিকালে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখেছি এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। এডিস মশা রাতেও সক্রিয় থাকার কারণ হিসেবে রাতের বেলা অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহারকে একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। অধ্যাপক বাশারের মতে, শহরে উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে। অতিরিক্ত আলোর কারণে একে তো মশা দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারছে না। তার ওপর এখন তারা রাতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নিয়েছে। আলোর সঙ্গে মশার আচরণ পরিবর্তনের বিষয়টি প্রথমবারের মতো তার সামনে এসেছে ২০১৯ সালে ঢাকার বিমানবন্দরে কাজ করতে গিয়ে। ওই বছর বিমানবন্দরে মশার কারণে একটি ফ্লাইট দুই ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়। সে সময় বিমানবন্দরে মশার ঘনত্ব পরীক্ষা করতে তার ডাক পড়ে। রাতের বেলা মশা ধরতে গিয়ে তারা দেখতে পান যে, বিমানবন্দরের ভেতরে উজ্জ্বল ও মৃদু আলোর মধ্যে এডিস মশা বিচরণ করছে। তারপরেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। ঢাকায় আরো বিভিন্ন স্থানে তার পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এডিস মশা উজ্জ্বল কিংবা মৃদু সব ধরনের আলোতে সক্রিয় থাকে। তাই ঘর আলোকিত থাকলে রাতেও কামড়াতে পারে এই প্রজাতির মশা।

এদিকে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে মশা নিধনে গাফিলতির জন্য নয় কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর মৃত্যু নিয়ে তোলপাড়ের মধ্যে সিটি কর্পোরেশন এ সিদ্ধান্ত নিল। ৬ জুলাই এ তথ্য নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিধন কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম মাহী।

তিনি বলেন, ৫ জুলাই বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত নগরীর সব ওয়ার্ডে একযোগে মশার ওষুধ ছিটানোর কর্মসূচি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ছয় ওয়ার্ডে সঠিকভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজন্য এসব ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা জোন কর্মকর্তা, সুপারভাইজার, স্প্রেম্যান ও তত্ত্বাবধায়ককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে- দক্ষিণ কাট্টলী, দেওয়ানবাজার, জামালখান, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, পশ্চিম মাদারবাড়ি ও গোসাইলডাঙ্গা।

তিনি বলেন, নির্দেশনা ছিল, বিকাল ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত নির্দিষ্ট স্থানে মশার ওষুধ স্প্রে করা হবে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেখানে মশার ওষুধ ছিটাননি বলে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। অবশ্য তারা বলছেন, স্প্রে করেছেন। কিন্তু তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই।