ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রোগী মৃত্যুর অভিযোগে চিকিৎসক গ্রেপ্তার

স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেতাদের

স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেতাদের

ভুল চিকিৎসার অভিযোগ এনে প্রমাণ ছাড়াই চিকিৎসকের জেল-জরিমানা করা হলে কোনো চিকিৎসক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে এগিয়ে আসতে চাইবে না। এতে করে উল্টো আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে এবং একপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার ভিত ভেঙে পড়তে পারে। প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) নেতারা এমন আশঙ্কার কথা বলেছেন। গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা এই শঙ্কার কথা জানান।

অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই সেন্ট্রাল হসপিটালের দুই চিকিৎসক ডা. শাহজাদী এবং ডা. মুনার মুক্তির দাবি ও সারা দেশে চিকিৎসক নিগ্রহের প্রতিবাদে ওই কর্মসূচির আয়োজন করে সংগঠনটি।

ওজিএসবির সাবেক মহাসচিব ও দেশের প্রখ্যাত গাইনি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বেগম বলেন, সেন্ট্রাল হাসপাতালে রোগী মৃত্যুর ঘটনায় ডা. শাহজাদী এবং ডা. মুনাকে অভিযোগ প্রমাণের আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা তাদের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। এছাড়াও যে কনসালটেন্ট রোগীর প্রাণ বাঁচাতে রাতভর চেষ্টা করেছেন এবং দক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসা দিয়েছেন, সেই চিকিৎসক ডা. মিলিকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমরা এই নির্দেশের প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে মামলাটি প্রত্যাহারের আবেদন জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশেই আমাদের গাইনি চিকিৎসকরা কঠিন পরিস্থিতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাত-দিন কাজ করছেন। যার ফলেই মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আমাদের চিকিৎসকরা যদি এরকম পরিবেশে কাজ করে, ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ করতে গেলে যদি মায়ের মৃত্যু হয় এবং চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা এবং একপর্যায়ে যদি জেল হয়, তাহলে এক সময় হয়তো চিকিৎসা পেশায় কেউ আসতেই চাইবে না।

গুলশানআরা আরো বলেন, আমরা আজ সারা বাংলাদেশেই গাইনি চিকিৎসকরা মিলে এই প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছি। আমরা আশা করছি আমাদের সাংবাদিক ভাইয়েরা জনগণের কাছে বিষয়টিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরবেন। এতে করে আমরা গ্রেপ্তার হওয়া আমাদের বোনদের বাঁচাতে পারব।

এ সময় দুই চিকিৎসকের গ্রেপ্তারের ঘটনায় সেন্ট্রাল হসপিটালের ভূমিকার সমালোচনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, সেদিন সেন্ট্রাল হসপিটালের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে যারা ছিল, আমি বলব সেদিনের সে বিষয়টি তারা সঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারেননি। এটা খুবই নিন্দনীয়। সেদিন রোগী কুমিল্লা থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল হসপিটাল আসার পূর্বে রোগীর অবস্থা কী ছিল, বাচ্চার অবস্থা কী ছিল, আদৌ তার অবস্থা স্বাভাবিক ছিল কি না এটি তদন্ত করে দেখা উচিত। শুধু দাবি করলেই দুই চিকিৎসকের মুক্তি হবে না। এখানে সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে রোগীর বিষয়ে এভিডেন্স লাগবে।

তিনি বলেন, সুশীল সমাজসহ সব পেশার পেশাজীবীদের প্রতি আমার অনুরোধ, চিকিৎসকদের পাশে আপনারা দাঁড়ান। যারা আপনার আমার স্বাস্থ্যসেবায় নিজেদের উৎসর্গ করে চলেছেন, তাদের বিপদে এগিয়ে আসা আপনাদের দায়িত্ব।

কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, চিকিৎসা নেয়ার পর কোনো রোগীর যদি মৃত্যু হয়, সে মৃত্যুর দায় কোনোভাবেই চিকিৎসকের ওপর আসতে পারে না। চিকিৎসকরা নিজের সর্বোচ্চটাই দিয়ে থাকেন। কোনো চিকিৎসকই চান না তার রোগীটির মৃত্যু হোক। এ বিষয়টি আমাদের বুঝতে হবে।

তিনি আরো বলেন, কোনো রোগীর মৃত্যু হলেই যদি চিকিৎসকের জেল-জরিমানা হয়, তাহলে সংকটাপন্ন কোনো রোগের চিকিৎসাতেই চিকিৎসকরা এগিয়ে আসতে চাইবেন না। এতে করে আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ভিত নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে। সেটি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

এ সময় ওজিএসবির প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী বলেন, প্রসব বেদনায় কাতর জটিল রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে আমাদের ডাক্তাররা আজ জেলে। পৃথিবীর কোথাও এমন নজির নেই।

তিনি বলেন, জটিল রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে যদি চিকিৎসকরা হামলা মামলার শিকার হন, তাহলে চিকিৎসকরা আর জটিল রোগীর চিকিৎসা করতে সাহস পাবে না। এতে রোগী মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।

সংগঠনটির সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. সালমা রৌফ বলেন, কোনো মৃত্যুই কারো কাম্য নয়, কিন্তু জটিলতা এড়ানো যায় না। পৃথিবীর কোথাও জটিলতার জন্য ফৌজদারি মামলা হয় না। বিনা বিচারে গ্রেপ্তার চিকিৎসকদের জামিন না হওয়া দুষ্ট লোকদের সুযোগ করে দেয়ার শামিল। তাই চিকিৎসকদের জামিন ও মামলা প্রত্যাহার করা হোক।

প্রসঙ্গত, সেন্ট্রাল হসপিটালের অধ্যাপক ডা. সংযুক্তা সাহার (গাইনি) অধীনে গত ৯ জুন ভর্তি হয়েছিলেন মাহাবুবা রহমান আঁখি। কিন্তু সেদিন ডা. সংযুক্তা হাসপাতালেই ছিলেন না। পরে তার দুই সহযোগী চিকিৎসক আঁখির ডেলিভারি করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু জটিলতা দেখা দেয়ায় নবজাতককে এনআইসিইউতে রাখা হয়। একই সঙ্গে আঁখির অবস্থার অবনতি হলে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে ১০ জুন বিকালে আঁখির নবজাতক সন্তান মারা যায়। এ ঘটনায় আঁখির স্বামী ইয়াকুব আলী ধানমন্ডি থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলায় ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা, ডা. মুনা সাহা, ডা. মিলি, সহকারী জমির, এহসান ও হাসপাতালের ম্যানেজার পারভেজকে আসামি করা হয়। এ ছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজনকেও আসামি করা হয়েছে। মামলা দায়েরের পর ১৫ জুন রাতে ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনা সাহাকে হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত