জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ

নিজস্ব বলয় তৈরির চেষ্টায় বিদেশি কূটনৈতিকরা

* অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে বাংলাদেশের * ইইউ নয়, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরই: সুজন

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নিজের বলয় তৈরি ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে গত তিন মেয়াদের চেয়ে এবারের নির্বাচনে বিদেশি কূটনীতিকরা একধরনের চাপ তৈরির চেষ্টা করছেন। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের এমন হস্তক্ষেপকে রাজনৈতিক দলগুলোকেই দায়ী করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ একটানা তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়, অন্যদিকে মাঠের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে মরিয়া। ফলে এই প্রধান দুই দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে। এখানে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ যেমন আছে, তেমনি এই চাপের ভেতরে-বাইরে ভূ-রাজনীতিও আছে।

গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় চার দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছে নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। সেখানে দেশটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু ও ইউএসএআইডি এশিয়া ব্যুরোর উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলি কৌর প্রতিনিধি দলে রয়েছেন। এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন তারা। এছাড়া তারা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সংলাপ করার কথা রয়েছে।

জানা গেছে, গত রোববার ঢাকায় এসেছে ইইউ নির্বাচনি অনুসন্ধান টিম। এবারের জাতীয় নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি না সেই ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিতে দুই সপ্তাহের সফরে ঢাকা আসছে এই টিম। এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী টিম নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করে। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে এ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধি দলের পাঁচ সদস্য, সিইসির সঙ্গে অন্য নির্বাচন কমিশনার এবং ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির নির্বাচন পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞ চেলেরি রিকার্ডো। এর আগে গত সোমবার সচিবালয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির বৈঠক হয়।

ইইউর প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী টিম জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইইউ যত খুশি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে, সেখানে নির্বাচন কমিশনের কোনো আপত্তি নেই। তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে আবেদনগুলো এলে ভালো হয়। আরো কিছু ফরমালিটিস আছে। সেক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ক্লিয়ারেন্স দরকার হবে।

অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, তারা আমাদের ভোটার, ভোটকেন্দ্র, পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয় ও সিসি ক্যামেরার বিষয়ে জানতে চেয়েছেন। তাদের একটা টেকনিক্যাল টিম আগামী ১৮ অথবা ১৯ জুলাই আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাপনার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে। তাদের যে জিজ্ঞাসা ছিল কমিশন তাদের সন্তুষ্ট করেছে, তারা সন্তুষ্ট।

ইইউ প্রতিনিধি দলের প্রধান চেলেরি রিকার্ডো বলেন, আমরা বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে দুই সপ্তাহের সফরে এসেছি। আমরা প্রাক-নির্বাচনি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠাব। তার ভিত্তিতে আগামী নির্বাচনে ইইউ পর্যবেক্ষক পাঠাবে কি পাঠাবে না সেই সিদ্ধান্ত হবে।

গত সোমবার ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, কোনো উদ্বেগের কথা তারা বলেননি। তারা ভালোটা আশা করছেন। খারাপ কিছু নিয়ে কোনো কথা বলেননি। বাংলাদেশে একটি শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হোক, এটাই তারা চেয়েছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আরো শক্তিশালী ও পরিপক্বতা অর্জন করুক, এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের মধ্যে মূলত নির্বাচন নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের অগ্রগতি নিয়ে আমরা আলাপ করেছি। এতে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিও ছিল। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। তাদের সে কথাই বলেছি। শেখ হাসিনা সরকার নিয়মিত কাজ করে যাবে। এ সরকার নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করবে। সরকারি দল তখন কেবল রুটিনওয়ার্ক করবে, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেমনটি হয়।

তিনি বলেন, আমরা বলেছি তারা যদি পর্যবেক্ষক দিতে চায়, তাদের সুস্বাগত। তারা আসবেন, আমাদের অতিথি। যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন, একজন কূটনীতিক নিজের আওতার মধ্য থেকে কাজ করবেন। পর্যবেক্ষকদেরও দায়িত্ব পালনে ৪১ ভিয়েনা কনভেনশনের নীতিমালা আছে। তারা সেই নীতিমালার মধ্যে দায়িত্ব পালন করবেন। এখানে আমাদের কোনো আপত্তি থাকার প্রশ্ন নেই। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যবেক্ষকরা সরেজমিন দেখতে পাবেন, নির্বাচন কীভাবে হচ্ছে। এ নিয়ে বাদানুবাদের কোনো সুযোগ থাকবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার, পার্লামেন্টের বিলুপ্তি, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এসব নিয়ে কোনো কথা হয়নি ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে। তবে সরকারের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকেন্দ্রিক মাঠের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ভেতর বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে। কারণ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ স্থানীয় পর্যায়ের সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও বিএনপি বর্জন করেছে। নির্বাচনের সময় কাছাকাছি চলে এসেছে, সেজন্য জুলাই ও আগস্ট এই দুই মাস বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় বিদেশিদের তৎপরতা আরো বাড়বে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর ব্যাপারে কিছু নীতি অনুসরণ করে। তাদের বিবেচনায় তারা যদি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ না দেখে তাহলে সাধারণত তারা পর্যবেক্ষক পাঠায় না। গত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইইউর কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি বাংলাদেশে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করলেও জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। দেশের ভেতরে সুষ্ঠু ও অংশগ্রমূলক নির্বাচন আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ুন কবির বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সবাই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগিদের অবজ্ঞা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। দেশে সুষ্ঠু এবং অংশগ্রণমূলক নির্বাচন দরকার। এটা সবাই অনুভব করছেন। এটা সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুধাবন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, রাজপথে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে গেলে সংঘাত-সহিংসতা অনিবার্য। তাই আমাদের উচিত এখন রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে পথ বের করা। সবাইকে ছাড় দিতে হবে। অনঢ় অবস্থানে কোনো সমাধান আসবে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে বলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিদের বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। তাদের অনেকের এখানে বিনিয়োগ আছে। তাই তারা যার যার অবস্থান থেকে নিজেকে প্রকাশ করছে। এর সবটা যে সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আমি তা মনে করি না।