পাইপলাইনে ফাটল

গভীর সাগর থেকে বন্ধ তেল খালাস

প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

গভীর সাগরে পাইপলাইনের মাধ্যমে বড় অয়েল ট্যাঙ্কার থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাস ভেস্তে যেতে বসেছে। তেল খালাস শুরুর তিন দিনের মাথায় ফেটে গেছে সমুদ্রের তলদেশের পাইপলাইন। এখন পুরোনো পদ্ধতি অর্থাৎ অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে সেই বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কারের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস হচ্ছে। কবে ত্রুটিপূর্ণ পাইপলাইন মেরামত হবে কিংবা পাইপলাইনে তেল পরিবহন শুরু হবে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। ৫ জুলাই থেকে পাইপলাইনে তেল খালাস বন্ধের পর এক সপ্তাহ পার হলেও ফের খালাস শুরু করা যায়নি।

জানা গেছে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর গত ২ জুলাই সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ের (এসপিএম) মাধ্যমে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল খালাস শুরুর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। গত ৩ জুলাই সকাল সোয়া ১০টায় পুরোদমে তেল খালাস শুরু হয়। এর একদিন পর গত ৫ জুলাই ফেটে যায় সমুদ্রের তলদেশের পাইপলাইন। এরপরই জাহাজ থেকে পাইপলাইনে পরিবহন কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ‘এমটি হোরে’ নামক অয়েল ট্যাঙ্কারের ৮২ হাজার টন অপরিশোধিত তেল খালাস হচ্ছে দুই অয়েল লাইটার ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে। ইস্টার্ন রিফাইনারির এক কর্মকর্তা বলেন, পাইপলাইন ফেটে যাওয়ার কারণ তদন্ত করা হচ্ছে। তাছাড়া পাইপলাইনে তেল পরিবহন শুরু হয় পরীক্ষামূলকভাবে। ঠিকাদার এখনো আমাদের পুরো প্রকল্পের কাজ বুঝিয়ে দেয়নি। ঠিক কী কারণে তেল খালাস বন্ধ আছে তা এখনো প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান জানায়নি। পাইপলাইনের ক্রটি নাকি, পাইপলাইন ফেটে গেছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারব না। জানা গেছে, সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পের অধীনে দুটি পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। যার একটি অপরিশোধিত তেলের জন্য এবং অন্যটি ডিজেলের জন্য। গভীর সমুদ্রে একটি ভাসমান মুরিং পয়েন্ট এবং মহেশখালীতে একটি স্টোরেজ ট্যাংক টার্মিনাল স্থাপন করা রয়েছে। যাতে নিরবচ্ছিন্ন তেল খালাস করা যায়।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থায়নে ৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিপিসি। ২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া এ প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।

এর আগে গভীর সাগর থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে বহু প্রতীক্ষিত অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস শুরু হয়েছে। গত ২ জুলাই সন্ধ্যার দিকে তেল খালাসের জন্য বৃহদাকার অয়েল ট্যাঙ্কারের সঙ্গে পাইপ লাইন যুক্ত করার মাধ্যমে তেল খালাস প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত ৩ জুলাই সকাল থেকে পতেঙ্গায় অবস্থিত দেশের একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) স্টোরেজ ট্যাংকে জ্বালানি তেল ভরা হয়। অয়েল ট্যাংকার থেকে ৮২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড) খালাস করতে সর্বোচ্চ ৩২ ঘণ্টা থেকে ৩৫ ঘণ্টা লাগবে বলে কর্মকর্তারা ? জ্বালানি তেল খালাস প্রক্রিয়া শুরু উপলক্ষ্যে ২ জুলাই দুপুরে চট্টগ্রাম বন্দরের বিশেষায়িত জাহাজ কাণ্ডারি-৩ যোগে সাংবাদিকদের গভীর সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় চট্টগ্রামবন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, অনেক উন্নত দেশকে টেক্কা দিয়ে গভীর সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। সৌদি আরব থেকে আমদানি করা ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েলের পরীক্ষামূলক খালাস শুরু হয়েছে গভীর বঙ্গোপসাগরে। ১১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন দিয়ে এ তেল আসবে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারিতে। ৮ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের কারণে তেল খালাসের সিস্টেম লস ও খরচ কমার পাশাপাশি সময় ২৫ দিন কমে মাত্র ২ দিনে নেমে আসবে। প্রকল্প সম্পর্কে জানা গেছে, মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নে উপকূল থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) স্থাপন করা হয়েছে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুটি আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোডিং করা হবে। ১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাইপলাইন প্রথমে তেল নিয়ে আসা হবে কালারমারছড়ার সোনারপাড়া সিএসটিএফ বা পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাঙ্ক ফার্মে। পাইপলাইন কমিশনিং করার পর সেখানে থাকা হেজ, সার্কিট বাল্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এরপর স্টোরেজ থেকে বিভিন্ন পাম্পের মাধ্যমে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন পাড়ি দিয়ে তেল নিয়ে যাওয়া হবে পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির স্টোরেজ ট্যাঙ্কে।

ইস্টার্ন রিফাইনারির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, পাইপলাইনে ২০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এসপিএম থেকে মহেশখালীতে এসে যেখানে পাম্প হবে, সেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল থাকবে এক লাখ ২৫ হাজার টন। বাকি ৭৫ হাজার টন হবে ডিজেল বা পরিশোধিত তেল। এই পাইপলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে তেলের সংরক্ষণ ক্ষমতাও বেড়েছে। বর্তমানে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৫ লাখ টন সংরক্ষণ ক্ষমতা আছে। এর মধ্যে ক্রুড অয়েল সংরক্ষণ ক্ষমতা ২ লাখ ২৫ হাজার টন। বাকিটা পরিশোধিত তেল রাখার স্টোরেজ।

ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করা যায়। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন (এসপিএম) প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে। ২০১৫ সালে পাইপলাইন বসানোর প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। মোট ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। এর মধ্যেই প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যয়ও বেড়ে ৭ হাজার ১২৫ কোটি টাকায় ঠেকেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার ৬০১ কোটি টাকা দিচ্ছে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। প্রকল্পের অধীনে এক সেট এসপিএম-পিএলইএম, একটি ভাসমান বয়া, ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন, এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে এবং ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইন উপকূল দিয়ে, ২ লাখ ৮৮ হাজার ঘনমিটারের ছয়টি স্টোরেজ ট্যাংক, তিনটি ব্লক ভালব স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। বন্দর চেয়ারম্যান এসময় উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রকল্পের নানা ইতিবাচক দিক তুলে বলেছিলেন, আজকের দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটি দিন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের যে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন এই প্রকল্প সেই যাত্রাকে অনেক দূর এগিয়ে দিল। তিনি বলেন, প্রকল্পটির মাধ্যমে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা সুদৃঢ় হওয়ার পাশাপাশি তেল পরিবহন এবং ব্যবস্থাপনায় অনেক উন্নতি ঘটবে। পরিবেশ, প্রতিবেশসহ নানা খাতে সুফল মিলবে। এই উদ্যোগের ফলে দেশের শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।