ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দুর্ঘটনায় বাড়ছে প্রাণহানি

মহাসড়কের আতঙ্ক তিন চাকার যান

মহাসড়কের আতঙ্ক তিন চাকার যান

মহাসড়কে তিন চাকার (থ্রি-হুইলার) মতো যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবুও আইন এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে দেশের সড়ক-মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তিন চাকার ‘থ্রি হুইলার’ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক জাতীয় বিভিন্ন অবৈধ যানবাহন। গত শনিবার বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া হিসাবে এই ঈদে সড়কে ঝড়েছে ২৯৯ জনের প্রাণ। অন্যদিকে একাধিক সংস্থার হিসাবে জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৫০৪ জনের এবং জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে নিহত হয়েছে প্রায় তিন সহস্র মানুষ। এসব দুর্ঘটনায় মহাসড়কে থ্রি হুইলারের উপস্থিতিকেও দায়ি করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের শহর ও গ্রামে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, অটো চার্জার ভ্যান, নছিমন, করিমন, ভটভটি, থ্রি হুইলার জাতীয় ইজিবাইক, টেম্পো ও অযান্ত্রিক যানবাহন। নানা পদক্ষেপের পরও বিপজ্জনক এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কে বাধাহীনভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব যানবাহন। জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কড়াকড়ি ও বিধিনিষেধের পরও কেনো থামানো যাচ্ছে না তাদের?

অভিযোগ রয়েছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশার মালিকরা আইন মানতে নারাজ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের শহর-বন্দর-গ্রামের সড়ক ছেয়ে গেছে এসব ‘থ্রি হুইলার’ অটোরিকশা, রিকশা ও ইজিবাইকে।

হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রুট পারমিট ছাড়াই রাস্তায় চলাচল করছে এসব বাহন। অবাধ বিচরণের কারণে উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা, বিভাগীয় শহর, রাজধানীর অলিগলি এমনকি মহাসড়কেও সৃষ্টি হচ্ছে জটলা। সাধারণ রিকশার পাশাপাশি যান্ত্রিক যানবাহনের সাথে গতির পাল্লা দিতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এককথায় মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত থ্রি হুইলার এখন গলার কাঁটা। এছাড়া বিদ্যুৎ ঘাটতির ক্ষেত্রেও অনেকাংশে অবৈধ এ পরিবহন দায়ী বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ পরিস্থিতিতে নিষিদ্ধ ইজিবাইক বা অটোরিকশা বন্ধ করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে মহাসড়কে এসব যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা তা মানছেন না। ২০১৪ ও ২০১৭ সালে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে হাইকোর্টের একাধিক নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষা করেই মহাসড়কে চলছে অটো রিকশা ও থ্রি হুইলার জাতীয় যানবাহন। এমনকি সড়ক-মহাসড়কে উল্টোপথেই চলতে দেখা যায় চালকদের। অনেক সময় ইউটার্ন নেয়ারও ধার ধারে না। দ্রুতগতির সড়কে ডিভাইডারের ওপর দিয়েও পার হতে দেখা যায় অটেরিকশাগুলোকে। এতে প্রতিদিন ঘটছে অসংখ্য দুর্ঘটনা। পঙ্গু হচ্ছে হাজারো মানুষ। বাড়ছে যানজটের তীব্রতা। অতিষ্ঠ হচ্ছে জনজীবন। যেন দেখার কেউ নেই।

অথচ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার জনস্বার্থে ২২ জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিকশা, অটো টেম্পো এবং সব শ্রেণির অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে নিষিদ্ধ করে। এরপর পেরিয়ে গেছে সাড়ে ৭ বছর। নিষিদ্ধ ঘোষণা যেন কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কাজের কাজ বাস্তবে বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে সড়কে এসব দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃত্যুর ঘটনাও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। গত বছর ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য সেক্টরের উপ-পরিচালক মোখলেছুর রহমান ‘নিরাপদ সড়ক জোরদারকরণে গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, দুই ও তিন চাকার মোটরযান ব্যবহারকারীদের জন্য মাথার আঘাত মৃত্যুর প্রধান কারণ। গবেষণা বলেছে, মহাসড়কে অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ি এসব থ্রি হুইলার পরিবহন।

অন্যদিকে অভিযোগ আছে, সড়কে অবৈধ যানবাহন আটক করে প্রাথমিকভাবে জরিমানার চেয়ে কম টাকা নিয়ে অনেক সময় থানা কম্পাউন্ড থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় থ্রি-হুইলার (ব্যাটারিচালিত রিকশা)। আবার কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তাকে নির্দিষ্ট মাসোহারা দিয়েই মহাসড়কে ঝুঁকি নিয়ে অবাধে চলছে এসব যানবাহন। এতে করে আইনের দোহাই দিয়ে থ্রি-হুইলার ধরা ছাড়া এ লুকোচুরির খেলায় কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা লাভবান হলেও সরকার হারাচ্ছে বিপুল রাজস্ব। অন্যদিকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জেনেও একই ভুল করে বারবার জরিমানা কিংবা উৎকোচ দিয়ে মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চালাচ্ছেন চালকরা। এতে করে যেমন মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনাও। জেলা ট্রাফিক বিভাগ ও হাইওয়ে পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েই রাস্তায় চলছে অটোরিকশা।

ঢাকার বাহিরে একাধিক জনের সাথে কথা বললে তারা জানান, থ্রি হুইলারের কারণে মহাসড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রাফিক বিভাগের কাছে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও পুরো দেশজুড়েই চলছে থ্রি হুইলার জাতীয় অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। ধারণা করা হচ্ছে, এ সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখের কাছাকাছি।

সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের ১ আগস্ট থেকে দেশের ২২টি মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে তিন চাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নছিমন, করিমন, ভটভটি চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। প্রয়োজনে মহাসড়কে তিন চাকার গাড়ির জন্য আলাদা লেন চিহ্নিত করে দেয়া হবে। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রথম দিকে পুলিশি তৎপরতায় মহাসড়কে এসব যান চলাচল কমে যায়। এ সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাও কমতে থাকে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই মহাসড়ক আবার তিন চাকার গাড়ির দখলে চলে যায়। এর ফলে সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।

২০২০ সালে বুয়েটের এক গবেষণায় দেখা যায়, থ্রি হুইলার জাতীয় পরিবহনের সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩১২টি এবং ২০২১ সালে এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩৯ অর্থাৎ তিন গুণ। গত বছরের সংখ্যা এখনো জানা না গেলেও তা চক্রহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সড়কে তিন চাকার যানবাহন বন্ধে প্রতিনিয়ত তাদের কার্যক্রম চলমান। তবে অটোচালকরা গরিব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ছড়াছড়ি। এরা সুযোগ পেলেই মহাসড়কে নেমে পড়ে। আবার পুলিশ দেখলে ফিডার সড়কে ঢুকে পড়ে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করেন বুয়েটের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। তিনি বলেন, রেজিস্ট্রেশনবিহীন যেসব গাড়ি যেমন- ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, নছিমন, করিমন সেগুলোর বিষয়ে করণীয় কী এগুলো কেউ ভাবছেন বলে মনে হচ্ছে না। সারাদেশে শুধু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাই আছে ১৫ লাখের বেশি। স্থানীয় পর্যায়ের এসব গাড়ি নিয়ে আমরা খুব ঝুঁকির মধ্যে আছি। প্রতিদিনই এসব গাড়ির জন্য সড়কে দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ। এসব গাড়ির চালকের গাড়ি চালানোর কোনো দক্ষতাই নেই। নেই গাড়ির কোনো নিবন্ধনও। বিআরটিএ এসব গাড়ির বিষয়ে এখনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন বুঝি না। মহাসড়কে ধীরগতির এসব ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন দুর্ঘটনার বড় কারণ। মহাসড়ক সব সময় অবারিত থাকা উচিত। এসব ছোট গাড়ির জন্য আলাদা লেন করতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, সিঙ্গেল সড়কগুলো যখন সরাসরি মহাসড়কে সঙ্গে সংযুক্ত করে দেয়া হয় আর আইন করা হয় এসব তিন চাকার যান মহাসড়কে ওঠা নিষেধ, তাহলে বিকল্প রাস্তা প্রয়োজন এর জন্য। আর বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না করে আইন করে কখনোই এসব যানবাহন বন্ধ করা সম্ভব নয়। কেন না ২০০৯ সালে যখন চীন থেকে এসব যানবাহন আমদানি হয়েছে তখনই এ বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার ছিল। গত ১৫ বছরে ৪০ লাখ মানুষের কর্ম নির্ভর করে এখানে।

তিনি বলেন, সব মহাসড়কের দুই পাশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সার্ভিস রোড চালু করতে হবে। এতে মহাসড়ক একদিকে ঝুঁকিমুক্ত হবে এবং থ্রি-হুইলারসহ অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল বন্ধ হবে। আনফিট যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রায় আড়াই লাখ অটোরিকশা আমদানি করা হয়েছে গত ৬ বছরে। এর অর্ধেক লাইসেন্স পায়নি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা চাঁদা দিয়ে চলছে। ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, ভটভটি একই প্রক্রিয়ায় চলছে।

তিনি বলেন, মহাসড়ক নিরাপদ করতে হলে জাতীয় সড়ক কাউন্সিলের দেয়া ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। সিটি সার্ভিসের ৯৮ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলাচলের অযোগ্য। আন্তঃজেলা দূরপাল্লার ৪৮ শতাংশ বাস ২০ বছরের বেশি পুরোনো। আনফিট, লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন সরিয়ে নিতে হবে। তাছাড়া দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। পরিকল্পনা করে মহাসড়কগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন খুবই জরুরি। পুলিশ ও মালিক-শ্রমিকদের চাঁদাবাজি বন্ধ করা জরুরি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত