উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী

হাসপাতালে বেড সংকট ফ্লোরে চলছে চিকিৎসা

প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

এডিস মশার কামড়ে প্রতিদিন শতশত মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগীদের চাপ বেড়েছে হাসপাতালগুলোতে। বিপজ্জনক অবস্থায় চলে গেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এতে হাসপাতালে বেড সংকট দেখা দিয়েছে। ফ্লোরে প্লাস্টিকের পাটি বিছিয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে ডেঙ্গু রোগীদের।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের চেয়ে চলতি বছরে ঢাকা শহরের ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা বেশি মিলেছে। ফলে ঢাকাসহ সারা দেশে দিন যত যাচ্ছে, ডেঙ্গু পরিস্থিত ততই খারাপ হচ্ছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ১৭ হাজার ৮৩১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ১১ হাজার ৯৪১ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫ হাজার ৮৯০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১৩ হাজার ৫১৮ জন।

গতকাল শুক্রবার বিজ্ঞপিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় (গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো ৪৪৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৮৪ জন। আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৬৫ জন। তবে এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ডেঙ্গুরোগী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নামে মাত্র ১০ টাকার টিকিট কেটে চিকিৎসা নেওয়া যায় ঢামেক হাসপাতালে। তবে হাসপাতালে বেডের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ডেঙ্গু রোগী ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শুধু ঢামেক হাসপাতাল নয়, রাজধানীর মুগদা মেডিকেল হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেড সংকটে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মেঝেতে। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে বেড সংকটে রোগীরা ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

ডেঙ্গুরোগের বাহক এডিস মশা নিধনের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আয়োজিত গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে দাবি করা হয়, এডিস মশার বিস্তার রোধে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন ভূমিকার জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে, দোষীদের শাস্তি দিতে হবে। জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, পরিস্থিতি খারাপ হলেও মশক নিধন কমিটি করা হয়নি। এর জবাব কে দেবে? জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করছে; কিন্তু জনগণকেই নিরাপত্তা দিতে পারছে না।

বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় দেশের সব জেলা থেকে রোগী ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হয়। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী রোগীর সঙ্গে একজন স্বজন থাকছেন। গতকাল শুক্রবার ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনের ছয়তলায় ওয়ার্ডের বাইরে ফ্লোরে, লিফটের সামনে প্লাস্টিকের পাটি বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা।

এ বিষয় হাসপাতালের প্রশাসনিক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, চলতি বছরের জুন থেকে ডেঙ্গুরোগীদের চাপ কয়েক গুণ বেড়েছে। হাসপাতালে বেডের চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। বাধ্য হয়ে অনেক রোগী ফ্লোরে প্লাস্টিকের পাটি বিছিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কারণ এখানে ভর্তি রোগীদের মধ্যে অধিকাংশই গরিব। নাম মাত্র ১০ টাকা দিয়ে টিকিট নেওয়ার পর রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা রোগীদের অনেকে কাঁথা, কম্বল ও বালিশ নিয়ে হাসপাতালে আসেন।

ঢামেক দেশের দরিদ্র মানুষের কাছে সবচেয়ে আস্থার হাসপাতাল। এটি জাতীয় হাসপাতাল, কোনো রোগীকে এখান থেকে ফিরিয়ে দেয়ার নজির নেই। এখানে শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওয়ার্ডে জায়গা না থাকলেও হাসপাতালের ফ্লোরে রেখে চিকিৎসকরা রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।

ঢামেক নতুন ভবনের ছয় তলায় পাটি বিছিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি সময় ডেঙ্গু রোগীর স্বজন শরিফুল ইসলাম জানান, তাদের বাড়ি জামালপুর। স্থানীয় হাসপাতালে ডেঙ্গুজ্বর ধরা পড়ে, সেখান কার চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকা মেডিকেলে এসেছি। রোগীর রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা ৪০ হাজারের কম পাওয়া যাচ্ছে। বারবার প্লাটিলেট কমছে। কিন্তু হাসপাতালে বেড সংকট থাকায় ফ্লোরে পাটি বিছিয়ে থাকতে হবে।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বেঠকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। নগরবাসীকে সচেতন করার জন্য বছরব্যাপী সিটি করপোরেশন কঠিন অবস্থানে থাকবে। কোথাও ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করছে উত্তর সিটির ভ্রাম্যমাণ আদালত। অন্যদিকে গত বুধবার ধানমন্ডির মধুবাজার জামে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন না হয়, তাহলে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা যাবে না। মেয়র আরও বলেন, ‘আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত এখন পর্যন্ত ২ হাজার ১৩৩টি বাসাবাড়ি ও স্থাপনায় অভিযান চালিয়েছে। এর মধ্যে ১৩৩টি জায়গায় আমরা লার্ভা পেয়েছি। তবে এই পরিসংখ্যান দিয়ে পুরো পরিস্থিতি বিচার করা যাবে না। কারণ, একটা পাত্রের লার্ভাই পুরো এলাকায় হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই আমরা চাইব, সবাই যেন দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। নিজেদের আবাসন ও আঙিনা নিজেরাই পরিষ্কার রাখে। আমাদের যেসব বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, স্থাপনা রয়েছে তাদের স্ব-স্ব দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা একটু সচেতন হলেই আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে পারব।

এ বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সমন্বিত বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থা প্রয়োগ না করলে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ফগার মেশিনে ওষুধ ছিঁটালে এক জায়গার মশা অন্য জায়গায় উড়ে যায়। এক্ষেত্রে ফগারে মশা নিধন ওষুধ ছিঁটিয়ে খুব একটা লাভ হয় না।

তিনি আরো বলেন, ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে। অন্য বছরের চেয়ে এ বছর সর্বোচ্চ মাত্রায় ডেঙ্গুর আক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে শতাধিক মানুষ। ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুর রোগীর সংখ্যা। কোনোভাবেই এডিস মশা ঠেকানো যাচ্ছে না।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম চালানো হলে, এখন কার পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না। আমরা জানি এডিস মশার জন্ম হয় বিভিন্ন পাত্রে বা বাড়ির কোনায় জমে থাকা পানিতে। নাগরিকরা যদি সচেতন হতেন, নাগরিকরা যদি সম্পৃক্ত হতেন, তারা যদি নিশ্চিত করতেন যে তাদের বাড়ির আঙিনায় কোনো পাত্রেই পানি জমে থাকবে না যেখানে এডিস মশা জন্মাতে পারে, তাহলে হয়তো এই প্রকোপ কম থাকত। এজন্য আমি বলব, নগরবাসীর সচেতনতা এবং সিটি করপোরেশনের বছরব্যাপী মশা নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া জরুরি। তাহলে হয়তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

এ ব্যাপারে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, মশক নিধন কার্যক্রমে গাফলতি রয়েছে সিটি করপোরেশন ও সেবা সংস্থাগুলোর। সচেতনতা সৃষ্টিতে সিটি করপোরেশনের যেমন দায়িত্ব আছে, ঠিক তেমনি নাগরিক হিসাবে আমাদের দায়ও কম নেই। এডিস মশা যেন কামড়াতে না পারে, সেজন্য নিজেকে ঢেকে রাখতে হবে। মশা নিয়ন্ত্রণ কৌশলে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষকে এডিস নিধনে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। এটি ওই সংস্থাগুলোর চরম ব্যর্থতা।