ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকা ছাড়লেন আজরা জেয়া

বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

সাক্ষাৎ না পেয়ে হতাশ বিএনপি
বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সফর শেষে এক বার্তায় তিনি এ কথা জানান।

গতকাল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লুসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা ও কক্সবাজারের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজের সদস্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী ও মানবিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে ১১-১৪ জুলাই বাংলাদেশ সফর করেন। বাংলাদেশ সফরকালে আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও বাংলাদেশ সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া তিনি শ্রমিক আন্দোলনকর্মী, নাগরিক সমাজের নেতা ও মানবাধিকার রক্ষাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, মানবাধিকার রক্ষাকর্মী, সাংবাদিক ও শ্রমিক আন্দোলন কর্মীদের নিরাপত্তার গুরুত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা থাকা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শন ও সেখানকার ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন। সেই সময় তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের উদ্যোগগুলোর সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরো ৭৪০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান ঘোষণা করেন। যার মধ্যে প্রায় ৬১০ কোটি টাকা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠী ও অন্যান্যদের সহায়তার জন্য দেওয়া হবে। এর মধ্য দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এ অঞ্চলে রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য আমেরিকার সহায়তার পরিমাণ ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়াল। এছাড়া আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া ফ্রিডম ফান্ড ও এর অংশীদারদের জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ১০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান ঘোষণা করেন। এ টাকা মানব পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ৫ শতাধিক শিশুকে সমাজে পুনঃএকত্রীকরণের কর্মসূচিতে ব্যবহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র মানব পাচারের অভিশাপ মোকাবিলায় সরকার ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিবেদিতভাবে কাজ করছে।

আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

চার দিনের বাংলাদেশ সফর শেষে তিনি ঢাকা ছেড়েছেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেছেন। তবে তিনি বাংলাদেশের রাজপথের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে কোনো বৈঠক করেননি। বিএনপির শীর্ষ স্থানীয় নেতারা গত বেশ কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে মার্কিন প্রতিনিধিদল আসার অপেক্ষায় ছিলেন। তারা মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করবেন, তারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তাদের কাছে ‘নালিশ’ করবেন। তাদের ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্র দয়াপরবশ হয়ে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতার মসনদ পরিবর্তনে সহায়তা করবেন। অথচ তার কোনোটিই করেনি মার্কিন প্রতিনিধিদল। ফলে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা অনেকটা হতাশা হয়েছেন। আর বিএনপির নেতাকর্মীরা হয়েছেন আশাহত। মার্কিন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সরকারের যেসব শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সেখানে ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কথা বললেও বিএনপির দাবি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন তত্ত্ববাধায়ক সরকার প্রসঙ্গে কোনো কথাই বলেননি মার্কিন প্রতিনিধিদল। এ বিষয়ে তারা কোনো প্রশ্ন করেনি কিংবা সরকারের কাছ থেকে কোনো মতামতও চাননি। তারা বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সরকারের তরফ থেকে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে অসাংবিধানিক কোনো সরকার দেশ পরিচালনা করতে পারে না। আইন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। সে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ আর নেই। মার্কিন প্রতিনিধিদল এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি অগ্রবর্তী দলের সদস্যরা রাজধানীতে অবস্থানকালে গত বুধবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খুব কাছাকাছি অবস্থানে দুটি মহাসমবেশ কর্মসূচি পালন করে। বিএনপির মহাসমাবেশ থেকে তত্ত্বাবধায় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা ঘোষণা দেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে বলেন, এই আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে দেয়া হবে না। এদিকে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট এলাকায় আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপির প্রতি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, আমাদেরও এক দফা, আর সেটা হচ্ছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন। তিনি বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন, আর নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দেবে নির্বাচনকালীন সরকার। সংবিধান বহির্ভূত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কোনো অবস্থায় দেশে ফিরে আসবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের প্রধান এই দুটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশ দেখে তারা আশ্বস্ত হয়েছেন যে, বাংলাদেশে আগামী দিনে সহ-অবস্থানের রাজনীতির ভবিষৎ উজ্জ্বল। বিএনপি তাদের সমাবেশে লোক সমাগম করার মধ্যদিয়ে বিদেশি মেহমানদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল যে, তাদের সঙ্গে এ দেশের মানুষ রয়েছে। আর তাদের দাবি হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সেই প্রত্যাশা বিএনপির পূরণ হয়নি। এদিকে আওয়ামী লীগও শান্তি সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে জনগণ আছে বলে প্রমাণ করেছে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে অতীতের মতো জ্বালাও পোড়াও কিংবা ভাঙচুর করার মতো সাহস দেখায়নি বিএনপি। একইদিনে একই সময়ে অল্প দূরত্বের ব্যবধানে এমন দুটি প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ দেখে বিদেশিরা আশ্বস্ত হয়েছেন। তবে সেইসঙ্গে তারা পরোক্ষভাবে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যে সুষ্ঠুভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কিংবা পরে কোনো প্রকার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আশ্রয় নিলে মার্কিন ভিসানীতি কাজে লাগানো হবে।

সরকারের যেসব মহলের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের আলাপ আলোচনা হয়েছে সেই প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তারা এটাই স্পষ্ট করেছেন যে, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঢাকার দৃঢ় অঙ্গীকার প্রত্যক্ষ করেছেন।

গত বুধবারের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশের বিষয়ে মন্তব্য করে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বলেন, ‘আমরা সৌভাগ্যবশত গুরুতর সহিংসতামুক্ত বড় রাজনৈতিক সমাবেশ প্রত্যক্ষ করেছি এবং আমি মনে করি, আমরা যেমন দেখতে চাই- এটি তেমন সমাবেশের উত্তম সূচনা।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন এবং দেশের শাসনব্যবস্থায় বাংলাদেশিদের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্ভর করে।’ আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগামী ৫০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা আরো গভীর করার জন্য উন্মুখ। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়ন, অর্থনীতি, মানবিক সহায়তা এবং নিরাপত্তার বিষয়ে সহযোগিতা থেকে ওয়াশিংটনের শক্তিশালী অংশীদারিত্ব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিস্তৃতি প্রতীয়মান হয়।

বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া। আজরা জেয়া ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে উদারভাবে আতিথ্য দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।

আজরা জেয়া একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকারের প্রশংসা করেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান জানিয়েছেন, নির্বাচন নিয়ে অবাধ-সুষ্ঠু ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা আর নতুন কিছু বলেননি। তারা শুধু এটিই চান, আমরাও সেটিই চাই।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সে কারণেই র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি আরোপ করা হয়েছে। তবে এ সফরের মধ্যে দিয়ে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে আমরা আশা করি।

এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, আগামী দ্বাদশ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনেই হবে। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১১ জুলাই থেকে চার দিনের সফরে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া। তার সফরসঙ্গী হিসেবে সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং ইউএসএইডের এশিয়া ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রের অঞ্জলী কৌর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত