উন্নয়নের নতুন ইতিহাস

* ডাবল লাইনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ * ব্যয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা * সময় সাশ্রয় হবে আড়াই ঘণ্টা

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

অভূতপূর্ব উন্নয়নে বদলে যাচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল পথ। এক সময় যা কল্পনায় ছিল এখন তা বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে যাতায়াতে এখন লাগবে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা থেকে ছয় ঘণ্টার স্থলে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা। আগামী ২০ জুলাই লাখসাম-আখাউড়া ৭২ কিলোমিটার ডাবল রেললাইন চালু হচ্ছে। আর এই দিন থেকে ৫২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রেন চলবে অন্তত দেড় ঘণ্টা কমে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায়। পাকিস্তান আমল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ সামরিক শাসন আমলে এই উদ্যোগটি কার্যত ভেস্তে যায়। বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই সারা দেশের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ উন্নয়নে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় লাকসাম-আখাউড়া ডাবল রেললাইন উন্নীত করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। স্থিতিশীল সরকার থাকায় প্রকল্প কাজ কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই দ্রুত এগিয়ে যায়। আর সেই প্রকল্পের সুফল ২০ জুলাই থেকে পেতে যাচ্ছেন এই পথে চলাচলকারী হাজার হাজার যাত্রী।

রেলওয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের লাকসাম-আখাউড়া ৭২ কিলোমিটার ডাবল রেললাইনের কাজ শেষ হয়েছে বেশ আগেই। কিছু কাজ বাকি ছিল তাও শেষ করা হয়েছে। আগামী ২০ জুলাই ডাবল লাইনের উদ্বোধন করা হবে। স্বাধীনতার ৫২ বছরে এসে প্রথমবারের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম ৩২১ কিলোমিটার রেলপথ ‘ডাবল লাইনে’ উন্নীত হলো। এটা উন্নয়নের নতুন মাইলফলক হিসেবে মনে করছেন নাগরিক সমাজ ও যাত্রীসহ সবাই। রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ডাবল লাইনে উন্নীত হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের প্রতিটি আন্তঃনগর এবং মেইল এক্সপ্রেসের যাত্রার সময় ঘণ্টা বাঁচবে। প্রতিটি ট্রেন নির্দিষ্ট গতিসীমায় ছুটতে পারবে। এখন তূর্ণা এক্সপ্রেস, সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেন সাড়ে ৫ ঘণ্টা থেকে পৌনে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে গন্তব্যে পৌঁছতে। সোনার বাংলায় সময় লাগে সাড়ে ৫ ঘণ্টা। এখন প্রতিটি আন্তঃনগর ট্রেনের দেড় ঘণ্টা সময় সাশ্রয় হবে। সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম ঢাকা পৌঁছতে পারবে। শুধু আন্তঃনগর নয় বাকি ট্রেনগুলোর চলাচলেও সময় বাঁচবে। সব চেয়ে বড় সুবিধা দুর্ঘটনার কারণে ট্রেন চলাচল দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকবে না। বিকল্প পথে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে।

জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ১১৮ কিলোমিটার আগে থেকেই ডাবল লাইন ছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনটি প্রকল্পের মাধ্যমে আরো ১৩১ কিলোমিটার ডাবল লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ৭২ কিলোমিটার রেলপথ ডুয়েল গেজ লাইনে উন্নীত করার জন্য লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। যা গত ৮ বছর ধরে চলেছে। শুরুতে লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন সাগর কৃষ্ণ চক্রবর্তী। তারপরে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. লিয়াকত আলীকে। তৃতীয় পর্যায়ে দায়িত্ব পান মোজাম্মেল হক। চতুর্থ প্রকল্প পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সাবেক মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার। পঞ্চম পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. আরিফুজ্জামান, ষষ্ঠ পিডি ছিলেন রেলের তখনকার যুগ্ম মহাপরিচালক (প্রকৌশল) রমজান আলী। সপ্তম প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মো. শহিদুল ইসলামকে। তিনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) পদোন্নতি পাওয়ার পর সর্বশেষ এই প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয় পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. সুবক্তগীনকে। মূলত তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর এই প্রকল্পের ছোটখাটো নানা জটিলতা কাটিয়ে প্রকল্পের কাজ বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যে শেষ করার উদ্যোগ নেন। দ্রুতগতিতে রাত-দিন কাজ করে প্রকল্পের কাজ শেষ করেন। যা আগামী ২০ জুলাই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে।

এই ব্যাপারে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে। আখাউড়া-লাকসাম ৭২ কিলোমিটার ডুয়েলগেজ ডাবল রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ২০ জুলাই উদ্বোধন হবে। এই ৭২ কিলোমিটার ডাবল লাইনের মধ্যদিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন পুরোটাই ডাবল লাইন ডুয়েলগেজে উন্নীত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম পুরোটাই ডাবল লাইন ডুয়েলগেজে উন্নীত হওয়ার মধ্যদিয়ে প্রতিটি ট্রেনযাত্রার সময় অনেকটা কমে আসবে। বিশেষ করে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোকে আমরা সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম পৌঁছানোর চেষ্টা করব। শুধু যাত্রী পরিবহন নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক অবদান রাখবে ডাবল লাইন। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, আখাউড়া-লাকসাম রেলপথ ডুয়েলগেজ লাইনের কাজ যৌথভাবে বাস্তবায়ন করেছে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন, বাংলাদেশের তমা কনস্ট্রাকশন ও ম্যাঙ ইনফ্রাকস্ট্রাকচারসহ যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (সিটিএম জয়েন্ট ভেঞ্চার)। এই প্রকল্পের ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৫০৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এরমধ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি ঋণ দিয়েছে ৪ হাজার ১১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ইআইবি ১ হাজার ৩৫৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। বাকি ১ হাজার ২৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে নিয়মিত চলাচলকারী যাত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল এই লাইনটি ডাবল লাইনে উন্নীত হোক। এখন প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আশা করছি এর সুফল দেশের মানুষ বিশেষ এই লাইনে চলাচলকারী লোকজন পাবে। কম সময়ে ট্রেনে চলাচল শুরু হলে সড়ক পথের যাত্রীরাও ঝুঁকবে ট্রেনের প্রতি। এতে রেলওয়ের আয়ও বাড়বে অনেক।