ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গুর মৃত্যুর রেকর্ড

আর কত মানুষ মারা গেলে ঘোষিত হবে জরুরি অবস্থা!

একদিনে ১৩ জনের মৃত্যু
আর কত মানুষ মারা গেলে ঘোষিত হবে জরুরি অবস্থা!

এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে গত দুইদিনে প্রায় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই সময়ে দুই হাজারের কাছাকাছি মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রোগী সুস্থ হওয়ার তুলনায় হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বেশি। এমতাবস্থায়, জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘জরুরি অবস্থা’ জারির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি একদিনে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। এই ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৯ জন, আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৫৪ জন। এ নিয়ে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু ১২৭ জনের এবং মোট সংক্রমিত হয়েছে ২৪ হাজার মানুষ।

জানা গেছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিনিয়ত মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে জেলার হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। মশার কামড়ে স্বজন হারিয়ে বাকরুদ্ধ পরিবারগুলো। বছরের শুরু থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মৃত্যু ১২৭ জন ছাড়িয়েছে। মৃতদের বেশিরভাগই শিশু। আক্রান্তের সংখ্যা ২৪ হাজার ছুঁই ছুঁই। এমন পরিস্থিতিতেও ডেঙ্গু বিষয়ে জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা। তবে জরুরি অবস্থার সময় আসেনি বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গত ৩ জুলাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী ইলমা জাহান মারা যায়। ইলমা একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ছিল। রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। শুধু ইলাম নয় জুন ও জুলাইয়ের শুরু থেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীর এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রকোপের মধ্যেও জরুরি অবস্থার পক্ষে নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মো. খুরশিদ আলম। তিনি গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যখন করোনা ছিল, তখন ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এটি ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি আমরা দেখছি না। তিনি বলেন, ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’র যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটা পলিসি লেভেলে আলোচনা করতে হবে। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ উচ্চপর্যায়ে জানিয়েছি। তারা নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন। মো. খুরশিদ আলম আরো বলেন, এবার বর্ষা দেরিতে শুরু হয়েছে তাই ডেঙ্গু মৌসুম লম্বা হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকট নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রাজধানীর সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

আশঙ্কাজনক হারে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে জানিয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এডিস মশা নিধনে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম ব্যর্থ। অথচ আগেভাগেই জনস্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা বলছিলেন- এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। এমন আশঙ্কা থাকার পরও ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন ও দেশের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থা মশা নিধনে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। ফলে এখন দৈনিক ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে এবং শতশত মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, এডিস মশার কামড়ে প্রতিদিন মানুষ মরছে। এমন অবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ- জনগণকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশা নিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাসে জনস্বার্থে জরুরি অবস্থা জারি করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের এ মতামতের পক্ষে সরকার অবস্থান নেবে বলে মনে করছেন ডা. লেলিন চৌধুরী।

অন্যদিকে কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, এডিস মশার কামড়ে প্রতিদিন মানুষ মরছে। এডিস মশা নিধনে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজে লাগাতে হবে। কারণ ডেঙ্গু পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সিটি করপোরেশন বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একার পক্ষে এটির নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এডিস মশা কোথায় আছে বা ঠিক কোনো বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী রয়েছে তা ওই বাড়ির লোকজনের পক্ষেই বলা সম্ভব। ওই বাড়ির লোকজন যদি স্বপ্রণোদিত হয়ে তথ্য সরবরাহ করে তাহলে করপোরেশনের পক্ষে লার্ভা ধ্বংস করা অধিকতর সহজ হবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চলতি বছরের শুরুতেই এডিস মশার প্রকোপের বিষয়ে জরিপ করা হয়েছে। সেই জরিপে আশঙ্কা করা হয়েছিল ভরা মৌসুমে এবার ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার আক্রমণ। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়াতে পারে আগের সব রেকর্ড। জুলাইয়ের ১৭ ও ১৮ এই দিনে তারই সংকেত পাওয়া গেল। সরকারি হাসপাতালগুলোর বেডের পাশাপাশি ফ্লোরে প্লাস্টিকের পাটি বিছিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা নিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় ভর্তি হতে হচ্ছে। ডেঙ্গুরোগী সুস্থ হওয়ার চেয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতি মুহূর্তেই চাপ বাড়ছে হাসপাতালে।

এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ‘জরুরি অবস্থা’ জারির প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যখনই কোনো রোগ প্রতি বছর সময়, জায়গা ও মানুষ বিবেচনায় যে হারে বিস্তার লাভ করে, তা যদি অস্বাভাবিকভাবে সংক্রমণ বেড়ে যায় এবং মৃত্যুর ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং তা যদি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে তা হলে মহামারি বলা যায়। আর যদি তা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয় কিংবা মানুষ যদি ঝুঁকির সম্মুখীন হয় তখন তাকে ‘জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি’ হিসাবে গণ্য করা হয়। দেশে এখন সেই পরিস্থিতি চলছে। সুতরাং ডেঙ্গু রোগতান্ত্রিকভাবে মহামারি রূপ নিয়েছে। আর তা মোকাবিলায় কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, দেশে ডেঙ্গু প্রকোপ শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নয়, গ্রামাঞ্চলেও রোগী বাড়ছে। কারণ অপরিকল্পিত ত্বরিত নগরায়ণ, জনঘনত্ব, গ্রাম ও শহরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে খারাপ করেছে। বিগত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু সংক্রমণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। তাই জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি ঘোষণা করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, গত ২৩ বছরেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। এ ছাড়া এটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন যেমন গবেষণা, সার্ভিলেস এবং কীটতত্ত্ববিদ ল্যাবরেটরি সেগুলো নেই। অর্থাৎ এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতাও আমাদের নেই। ফলে দেশে ডেঙ্গুর জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এখন এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন কিংবা স্থানীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দিনে দিনে মানুষের মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত