ডেঙ্গুজ্বরে নাকাল অবস্থার এ সময়ে চিকিৎসকদের আন্দোলন-ধর্মঘট মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে দেখা দিয়েছে চট্টগ্রামে। গত দুদিনের ধর্মঘটে চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। চিকিৎসকরা তো চিকিৎসা দিচ্ছেন না। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য রিপোর্ট পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ডায়াগস্টিক সেন্টারের সামনে ভিড় লেগেই আছে রোগীদের। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন ডেঙ্গু রোগীরা। ডাক্তাররা রোগ নিশ্চিত হতে পরীক্ষা দিলেও তা পেতে দেরি হচ্ছে। তাতে চিকিৎসাসেবাও বিঘ্নিত হচ্ছে। আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা জরুরি রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার কথা বললেও বাস্তবে তা নেই। অনেক হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা নিতে আসা রোগী স্বজনরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মুখে পড়েছেন। যেন দেখার কেউ নেই। ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের ঘটনায় দুই নারী চিকিৎসককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামেও সব ধরনের প্রাইভেট চেম্বার অপারেশন বন্ধ রেখেছেন চিকিৎসকরা। গতকাল সোমবার কর্মসূচির প্রথম দিন থেকেই দুর্ভোগ শুরু। গতকাল দিনভর তা অব্যাহত ছিল। অবস্ট্রেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনেকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)-এর এ কর্মসূচিতে সর্বস্তরের চিকিৎসক একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। একাত্মতার পাশাপাশি পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নিজেদের প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন। সরেজমিনে বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, ডাক্তার না থাকায় প্যাথলজি ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কার্যত বন্ধ। টেস্ট করালেও রিপোর্ট না পাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগীরা। টেস্টের জন্য সেম্পল বা ব্লাড সংগ্রহ করা হলেও রিপোর্ট সরবরাহে অপারগতার কথা জানিয়ে দেয়া হচ্ছে ল্যাব থেকে। একই পরিস্থিতি রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও। এক্সরে, এমআরআই, সিটি স্ক্যান করা হচ্ছে। কিন্তু রিপোর্ট দিতে পারছে না ল্যাবগুলো। আর রেডিওলজিস্ট না থাকায় আলট্রাসনোগ্রাফির মতো আরো বেশ কয়েক ধরনের টেস্ট করাই সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এসব পরীক্ষার রিপোর্ট দ্রুত পাওয়া জরুরি। অত্যন্ত জটিল রোগীরা এসব রিপোর্ট সংগ্রহ করতে পারছে না। অনেক পড়েছেন সংকটজনক অবস্থায়। নগরীর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের এক ডায়াগনিস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা জানান, আমরা রোগীদের কাছ থেকে সেম্পল কালেকশান করছি। অপেক্ষায় আছি চিকিৎসকরা তা দেখবেন। আশা করছি ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর পরই আমরা রোগীদের তা সরবরাহ করতে পারব। এই আন্দোলনের সঙ্গে প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্ট, সনোলজিস্টরাও একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। তাই এখনই রিপোর্ট দেয়া কঠিন।
আন্দোলনের কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন জরুরি অপারেশনের রোগীরা। নিয়মিত অপারেশন বন্ধ এবং কনসালটেন্টরা রোগী না দেখায় বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি কমেছে। তবে বেসরকারি বড় পরিসরের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা চলছে। এসব হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব এখনই পড়েনি। তবে আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা চাপ দিলে এসব হাসপাতালেও চিকিৎসাসেবা বন্ধের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বেসরকারি বড় পরিসরের হাসপাতালে তাদের নিজস্ব ডাক্তারদের দিয়ে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও সেবা চালু রয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি কমে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। চিকিৎসাসেবা দেয়ার সক্ষমতার তুলনায় এখন রোগী অনেক বেশি। এই হাসপাতালের পাশাপাশি আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালেও বেড়েছে রোগী সংখ্যা। সরকারি এই হাসপাতালে বাড়তি রোগীর সেবা দেয়ার মতো জনবল নেই। তাই চাপ সামলানোর মতো চিকিৎসা সেবা দেয়া এই হাসপাতালে কঠিন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে গেল দুদিন রোগীর চাপ বেড়েছে। আমরা কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দিচ্ছিনা। সব ধরনের রোগীর চিকিৎসা চলছে। ইমার্জেন্সিতে এখন চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। যাতে রোগীদের কোনো সমস্যা না হয়। প্রসঙ্গত, গেল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে সোম ও মঙ্গলবার সারাদেশে চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বার-অপারেশন বন্ধের ঘোষণার কথা জানায় অবস্ট্রেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনেকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি)। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যৌথভাবে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে বলেও উল্লেখ হয় বিজ্ঞপ্তিতে। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামেও এ কর্মসূচি পালন করা হবে বলে জানান বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি ডা. মুজিবুল হক খান এবং ওজিএসবি চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামরুন্নেছা রুনা।
এদিকে চট্টগ্রামে প্রায় প্রতিদিন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে নারী শিশু থেকে বৃদ্ধ সব শ্রেণির মানুষ। গেল দুদিনে ছয়জন মারা গেছে ডেঙ্গু জ্বরে। পরীক্ষা বন্ধ থাকায় কি পরিমাণ রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তার পরিসংখ্যান বের করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
নগরীর চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা এখলাছুর রহমান বলেন, ডাক্তাররা এ মুহূর্তে আন্দোলনে যাওয়া চরম অমানবিক। এখন কার্যত দেশে ডেঙ্গুর মহামারি অবস্থা। এই সময় আন্দোলন অব্যাহত রাখলে রোগী মৃত্যুর হার বাড়বে। আক্রান্তরাও সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। আশা করছি চিকিৎসকদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।