নিবন্ধন অধিদপ্তর

শিগগিরই নিয়োগবিধির প্রজ্ঞাপন

প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা নিবন্ধন অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধিমালা শিগগিরই হচ্ছে। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতামত নিয়ে বিধিটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করবে আইন মন্ত্রণালয়। ফলে বহুল কাঙ্ক্ষিত নিয়োগ বিধির মাধ্যমে প্রত্যাশা পূরণ হবে নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

জানা গেছে, নিয়োগ বিধি প্রণয়নের সারসংক্ষেপ সচিব কমিটি পাস হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পিএসসিতে পাঠানো হয়। পরে বিধি বিশ্লেষণ করে কিছু সংশোধনীর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে পিএসসি। বিধি সংশোধন করে আবারও পিএসসিতে পাঠাবে আইন মন্ত্রণালয়। এরপর পিএসসি চূড়ান্ত মতামত দিলে নিয়োগ বিধিমালা প্রজ্ঞাপন জারি করবে আইন মন্ত্রণালয়। নিয়োগ বিধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সরকারি যে কোনো সংস্থার নিয়োগ বিধিমালা পাস করতে মন্ত্রণালয় থেকে মতামতের জন্য পিএসসিতে পাঠাতে হয়। পরে বিধি পর্যালোচনা করে পিএসসি মতামত দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে। এসব ধাপ অতিক্রম করে নিয়োগ বিধিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

জানা গেছে, নিবন্ধন অধিদপ্তরে কর্মকর্তাদের জন্য ১৯৭৯ সালে নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু কর্মচারীদের জন্য বিধিমালা ছিল না। কর্মচারীদের জন্য পৃথক নিয়োগ বিধিমালা না থাকায় মাঠ পর্যায়ে অনেক সমস্যা ও জটিলতা বিরাজমান ছিল। তা নিরসনকল্পে কর্মচারীদের জন্য পৃথক নিয়োগ বিধিমালা তৈরি করার জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৮ সালে নিবন্ধন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করার সময় চার ধরনের কর্মকর্তার পদ সৃজন করা হয়। এসব পদকে নিয়োগ বিধিমালার তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে নতুনভাবে নিয়োগবিধি প্রণয়নের জন্য ২০২০ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব পাঠানো হয়। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়োগ বিধি পরিবীক্ষণ উপকমিটি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পৃথক বিধিমালা প্রণয়ন না করে একটি সমন্বিত বিধিমালা প্রণয়নের অভিমত দেয়। সে আলোকে নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি সমন্বিত নিয়োগ বিধিমালা খসড়া আইন মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। জনপ্রশাসন নিয়োগ বিধি পরিবীক্ষণ উপকমিটির সম্মতি লাভের পর তা প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের মতামতের জন্য পাঠানো হয়। পরে নিয়োগ বিধিমালার তফসিলের ২৪টি পদের মধ্যে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি অফিস সহায়ক ৬৫টি পদ নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। পরে বিধি সংশোধনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে বরাবর নিয়োগ বিধিমালা পাঠায় পিএসসি। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সৃষ্টি অফিস সহায়ক ৬৫টি পদ রাজস্ব খাতে স্থানান্তর সাপেক্ষে নিয়োগ বিধিমালাটি আইন মন্ত্রণালয় থেকে পিএসসিতে পাঠানো হবে। পিএসসি মতামতের পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং শেষে তা গেজেট আকারে প্রকাশ হবে। আগামী ২ মাসের মধ্যেই এসব প্রক্রিয়া শেষ হতে পারে।

বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েনের (বিআরএসএ) সাবেক মহাসচিব ও মানিকগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার মো. জাহিদ হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা ২০০৪ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকেই দেখে আসছি, নিবন্ধন অধিদপ্তর থেকে বারবার নিয়োগ বিধিমালার প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে জনপ্রশাসন বান্ধব সরকারের আমলে আইনমন্ত্রীর আন্তরিকতা ও সচিবের ঐকান্তিক চেষ্টায় এবার নিয়োগ বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার দ্বার প্রান্তে পৌঁছেছে। এই নিয়োগ বিধিমালা চূড়ান্ত রূপ লাভ করলে মাঠপর্যায়ে সময় মতো পদোন্নতির দ্বার উন্মোচিত হবে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে কর্ম চাঞ্চল্য ফিরে আসবে।’

এ বিষয়ে বিআরএসএ’র সাবেক মহাসচিব ও বর্তমান সিনিয়র সহ-সভাপতি নারায়ণগঞ্জ বন্দর সাব-রেজিস্ট্রার শেখ কাওসার আহমেদ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘নিয়োগবিধি চূড়ান্ত না হওয়ায় ২০১৮ সালে অধিদপ্তরে উন্নীত হওয়ার সময় সৃজিত পদগুলোতে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে ওই বিধিটি পিএসসিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই বিধি চূড়ান্ত হলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতার অবসান ঘটবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইনমন্ত্রী ও সচিবের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আইজিআর’র নেতৃত্বে নিয়োগ বিধিমালা খুব দ্রুতই আলোর মুখ দেখবে।’

নিবন্ধন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, জেলা রেজিস্ট্রার, সাব-রেজিস্ট্রারদের পেশাগত মানোন্নয়ন এবং ভাবমূর্তি বাড়াতে অতীতে একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেন। তার নেতৃত্বে নিবন্ধন পরিদপ্তর থেকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়। পুরোনো ধ্যানধারণার পরিবর্তন করে জমি রেজিস্ট্রি বিভাগকে আধুনিকায়ন ও ডিজিটালাইজড করা হয়। ফলে শত বছর ধরে অবহেলিত ও ঘুণে ধরা রেজিস্ট্রি বিভাগে অনেকটা গতি ফিরে এসেছে, কমেছে জনদুর্ভোগ। এছাড়া আইন মন্ত্রীর নেতৃত্বে চলতি বছরের ৬ জুলাই নকলনবিশদের পারিশ্রমিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধি হলেই প্রশাসনিক কাজের গতি, লোকবল, রাজস্ব বাড়বে এবং সর্বোপরি জনগণ আরো সেবা পাবে।

সূত্র জানায়, ২০২১ সালে নিবন্ধন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত করে। এরপর প্রণীত খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা হয়। এই বিধিমালা প্রণয়নের পর অন্যান্য অধিদপ্তরের মতো নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গাড়ি, জনবল নিয়োগ, স্থান সংকুলানসহ অন্যান্য ব্যবস্থা পাবে। সেই সঙ্গে বাড়বে রেজিস্ট্রেশন বিভাগের সুযোগ-সুবিধা।

এ বিষয়ে পিএসসি’র এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, সরকারি সংস্থার নিয়োগ বিধি করতে চাইলেই সহজে করা যায় না। একটা বিধিমালা প্রণয়নে কখন কখন কয়েক যুগ লেগে যায়। সেখানে প্রায় আড়াই বছরের মধ্যেই নিবন্ধন অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি হতে হচ্ছে। এই বিধি প্রজ্ঞাপনের মধ্যদিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতীক্ষার প্রবহর শেষ হবে।

কয়েকজন জেলা রেজিস্ট্রার ও সাব-রেজিস্ট্রার বলেন, চাকরির সঙ্গে মানুষের মর্যাদার বিষয়টি সম্পৃক্ত। নিবন্ধন বিভাগ পরিদপ্তর থাকা অবস্থায় কর্মকর্তারা মর্যাদা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। তাই এটিকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করা হয়। প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে গতি, সেবা ও সরকারের রাজস্ব কয়েকগুণ বেড়েছে।

আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নিবন্ধন অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ড নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় নিয়মিত কাজ করছে। জমি বেচাকেনায় মানুষের ভোগান্তি দূর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধিমালা করা হচ্ছে। অনেক সময় বিভিন্ন সংস্থার নিয়োগ বিধি তৈরির জন্য জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করতেও দেখা যায়। সেখানে নিবন্ধন অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি প্রায় আড়াই বছরের মধ্যেই আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি জমির দলিল রেজিস্ট্রেশন করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলো। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে এই জমি রেজিস্ট্রি বিভাগ। দীর্ঘ বছরের পুঞ্জিভূত অনিয়ম-দুর্নীতি থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে বের করে আনতে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। ঢেলে সাজানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব উদ্যোগের মাঝেই নিয়োগবিধির ইস্যুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই তো চুলচেরা বিশ্লষণ করে বিধিটি প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের পক্ষে আইন মন্ত্রণালয়। বিধিমালা বাস্তবায়ন হলে অধিদপ্তরের এমএলএসএস থেকে আইজিআর পর্যন্ত সবার পদমর্যাদা বিধিমালা অনুযায়ী উন্নীত হবে।

এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, নিবন্ধন অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধিমালা নিয়ে কাজ চলছে। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিয়োগবিধিা নিয়ে কয়েকটি মিটিং করেছেন। শিগগিরই প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ হবে বিধিটি।

উল্লেখ্য, উপমহাদেশের প্রাচীনতম একটি প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন বিভাগ। ১৭৮১ সালে নিবন্ধন বিভাগের যাত্রা শুরু হলেও ১৭৯৩ সালে বেঙ্গল রেগুলেশনের মাধ্যমে ঢাকায় প্রথম রেজিস্ট্রি অফিস স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯০৮ সালে উপমহাদেশের রেজিস্ট্রেশনের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হয়। আর ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি নিবন্ধন পরিদপ্তর থেকে অধিদপ্তরে উন্নীত করা হয়েছে। জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে সেবা দেওয়ার মধ্যদিয়ে জমির দলিল নিবন্ধন ও সম্পাদনের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় করছে। জমি রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালের ছোঁয়া লাগছে।