ঝালকাঠিতে ইজিবাইকে সাইড দিতে গিয়ে বাস পুকুরে

নারী-শিশুসহ নিহত ১৭ : আহত ২৫

প্রকাশ : ২৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বরিশাল ব্যুরো

একটি ইজিবাইকে সাইড দিতে গিয়ে ঝালকাঠির ছত্রকান্দা এলাকায় পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালগামী বাশার স্মৃতি পরিবহণ নামের একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে ১৭ যাত্রী নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে আটজন নারী ছয়জন পুরুষ ও তিনজন শিশু রয়েছে। এ সময় দুর্ঘটনাকবলিত ওই বাস থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় ২৩ যাত্রী। এদের মধ্যে প্রত্যেকেই কমবেশি আহত হয়েছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ঝালকাঠি সদর উপজেলার ছত্রকান্দা এলাকায় মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় আহতদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এছাড়া ঘণ্টাব্যাপী চেষ্টা চালিয়ে দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে ৬০ জন যাত্রী নিয়ে বরিশালের দিকে যাচ্ছিল (ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-৬৫৪) বাশার স্মৃতি পরিবহণ নামের বাসটি। পথে যাত্রী তুলে ৭০ থেকে ৮০ জন যাত্রী নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে চলতে থাকে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পথিমধ্যে সদর উপজেলার ছত্রকান্দা এলাকায় পৌঁছলে ইউপি ভবনের সামনের মোড় ঘুরতেই একটি ইজিবাইকে সাইড দিতে গিয়ে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পাশের পুকুরে পড়ে যায়। এ সময় ঘটনাস্থলে থাকা স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীরা ছুটে এসে দুর্ঘটনা কবলিত বাসে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা করে। খবর পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিস ও থানা পুলিশের একাধিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে পুরোপুরি উদ্ধার অভিযান শুরু করে। এ সময় বাসের গ্লাস ভেঙে ২৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হলেও এর মধ্যে ১৫ যাত্রী নিহত হন। নিহতদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশি। পরে জেলা পুলিশের উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে দুপুর সাড়ে ১২টায় দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি উদ্ধার করে। এ সময় বাসের ভিতর থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে মৃত্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ জনে। এছাড়া আহতাবস্থায় উদ্ধার হওয়া ২৫ জনকে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পুকুরে আর কোনো মরদেহ রয়েছে কি না, তা দেখতে দুটি সেচ পাম্প বসিয়ে পুকুরের পানি কমানো হচ্ছে।

ঝালকাঠি থানার অফিসার ইনচার্জ নাসির উদ্দিন সরকার জানান, আটজন নারী, ছয়জন পুরুষ ও তিন শিশুর মরদেহ উদ্ধারের পাশাপাশি আহত অবস্থায় ২৫ জনকে উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিহত যাদের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- তারেক রহমান (৪৫) পিতা পান্না মিয়া ভান্ডারিয়া পৌরসভা থানা ভান্ডারিয়া ; সালাম মোল্লা (৬০) পিতা মুজাফফর আলী ভান্ডারিয়া পৌরসভা থানা ভান্ডারিয়া; খাদিজা বেগম (৪৩) স্বামী-মৃত মাওলানা নজরুল ইসলাম; খুশবো আক্তার (১৭) পিতা মাওলানা নজরুল ইসলাম, গ্রাম নিজামিয়া থানা রাজাপুর; শাহীন মোল্লা (২৫) পিতা মৃত সালাম মোল্লা ভান্ডারিয়া পৌরসভা থানা ভান্ডারিয়া ; সুমাইয়া (৬) পিতা জালাল হাওলাদার গ্রাম পশারিবুনিয়া ভান্ডারিয়া ; আবদুল্লাহ (৮) পিতা দেলোয়ার হোসেন গ্রাম চর বোয়ালিযা বাখরগঞ্জ; রহিমা বেগম (৬০) স্বামী মৃত লাল মিয়া রিজাভ পুকুর পাড় ভান্ডারিয়া; আবুল কালাম হাওলাদার পিতা মৃত লাল মিয়া হাওলাদার; রিপামনি (২) পিতা- রিপন মেহেদীগঞ্জ সদর; আইরিন আক্তার (২২) স্বামী রিপন হাওলাদার মেহেদীগঞ্জ; নয়ন (১৬) পিতা নজরুল ইসলাম বলাইবাড়ী রাজাপুর; রাবেয়া বেগম (৮০) স্বামী মৃত ফজলুল হক মৃধা উত্তর শিয়ালকাঠি ভান্ডারিয়া; সালমা আক্তার মিতা (৪২) পিতা তৈয়বুর রহমান বাশবুনিয়া কাঠালিয়া।

ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন- আবুল বাশার কাঠালিয়া, রাসেল মোল্লা ভান্ডারিয়া, ফাতিমা ভান্ডারিয়া, রাসেল ভান্ডারিয়া, মিফতা নলছিটি, রিজিয়া কাঠালিয়া, রিজিয়া কাঠালিয়া, আরজু কাঠালিয়া, মনোয়ারা রাজাপুর, সুইটি ভোলা, রুকাইয়া বাউফল, আজিজুল নলছিটি, আলাউদ্দিন রাজাপুর, সোহেল রাজাপুর, আবুল কালাম রাজাপুর, আকাশ বরগুনা, সোহাগ সাতক্ষীরা, নাঈমুল মঠবাড়িয়া, সিদ্দিকুর বাউফল, মনিরুজ্জামান ভান্ডারিয়া, আল-আমিন ঝালকাঠি, সাব্বির বরিশাল। এছাড়া দুইজনকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. বৈশাখী বড়াল নিহত ও আহতদের সংখ্যা নিশ্চিত করে বলেন, চিকিৎসাধীন বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।

দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে আহত যাত্রী রাসেল মোল্লা জানান, ৪০ আসনের বাসটি সকাল ৮.৪৫ মিনিটে ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছাড়ে। পথিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী ওঠানোর কারণে যাত্রী সংখ্যা হয় প্রায় ৭০ জন। বাসটির ছাদেও কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। বাসটি দ্রুত গতিতে ঝালকাঠির ছত্রকান্দা ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ অতিক্রমকালে চালক মোহন সুপারভাইজারের সাথে কথা বলেছিল, এ সময় হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাসটি সড়কের বাম দিকের পুকুরে পড়ে যায়। ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম মাসুম বলেন, আমি পরিষদে লোকজন নিয়ে বসেছিলাম। হঠাৎ শব্দ শুনে বের হয়ে দেখি বাসটি পুকুরে পড়ে গেছে। এর মধ্যে পরিষদে যারা ছিলেন এবং আশপাশের লোকজন ছুটে এসে যেভাবে পেরেছেন লোকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। উদ্ধারকাজে অংশ নিয়ে আহত হওয়া স্থানীয় ইউপি সদস্য ফয়সাল রহমান বাবু বলেন, দুর্ঘটনার সময় আমি পরিষদের সামনেই ছিলাম। পুলিশ এবং দমকল বাহিনী পৌঁছার আগেই আমরা ৫০ থেকে ৬০ জন মিলে উদ্ধার অভিযান শুরু করি।

তিনি আরো বলেন সড়ক মহাসড়কের পাশে পুকুর বা জলাশয় থাকার কারণে মৃতের সংখ্যা বেশি হয়েছে। মহাসড়কের কাছে পুকুর খনন বন্ধ করা উচিত। ঝালকাঠি বাসমালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত বাসের ড্রাইভার এবং সুপারভাইজারের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। হেলপার আকাশকে (১৭) পাওয়া গেছে। ঝালকাঠির পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আফরুজুল হক টুটুল বলেন, পুলিশের আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের পক্ষ থেকে মরদেহ দাফন ও পরিবহণের জন্য ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান ১৭ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হবে।

পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক ফারাহ্ গুল নিঝুম জানান, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুন শিবলীকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি তিনদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।

শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না আইরিনের : ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বলাইবাড়ী এলাকার পিত্রালয় থেকে দেবর নয়ন ১৬ ও ২ বছরের শিশুকন্যা রিপাকে নিয়ে বরিশালের হিজলা উপজেলার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন আইরিন (২২)। পথিমধ্যে বাশার স্মৃতি পরিবহণের যাত্রী হন তারা। ছত্রকান্দা এলাকায় পৌঁছলে একটি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইককে সাইড দিতে গিয়ে বাসের চাকা ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে পুকুরে পড়ে যায়। নিহত ১৭ জনের মধ্যে আইরিন ও কন্যা নিপা এবং তার দেবর নয়ন রয়েছেন। ফলে দেবর ও কন্যাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফেরা হলো না আইরিনের। বাস দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন আইরিনের মা নুরজাহান বেগম। এখানে কাউকে না পেয়ে সদর হাসপাতালে ছুটে গিয়ে নিজ কন্যা আইরিন ও নাতনি রিপা ও পুত্রা নয়নের নিথর দেহ শনাক্ত করেন। মর্মান্তিক এ বাস দুর্ঘটনায় মেয়ে-নাতনি ও পুত্রা নয়নকে হারিয়ে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে আহাজারি করে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন নুরনাহার বেগম। শুধু নুরনাহারই নন, আত্মীয়স্বজনরাও হাসপাতালের ফ্লোরে আহাজারি করছেন। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে সদর হাসপাতাল চত্বর।