এডিস মশার কামড়ে বাড়ছে মৃত্যু

নাগরিকবান্ধব হয়নি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রায় প্রতিদিন এডিস মশার কামড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন শত শত মানুষ। অথচ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বিকার। অথচ নগরবাসীর ভোগান্তির কথা বিবেচনা করে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে স্বতন্ত্র দুটি সিটি করপোরেশন করা হয়। তবে এই দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজধানীর বাসিন্দারা।

জানা গেছে, ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০১১ সালে দুই সিটি করপোরেশনে বিভক্ত করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে ১৬টি ইউনিয়নকে ৩৬টি ওয়ার্ড করে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের যুক্ত করা হয়। এতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বিদ্যমান ৩৬টি ওয়ার্ডের সঙ্গে আরো ১৮টি যোগ হয়ে ওয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪টি। আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ওয়ার্ড ৫৭টি থেকে বেড়ে ৭৫টি হয়েছে। এতে ডিএনসিসির আয়তন ৮২ দশমিক ৬৩৮ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে ১৬০ দশমিক ৭৬৮ বর্গকিলোমিটারে দাঁড়ায়। একইভাবে ডিএসসিসির আয়তন ৪৫ বর্গকিলোমিটার থেকে বেড়ে ১০৯ দশমিক ১৯ বর্গকিলোমিটার হয়। সিটি করপোরেশন বিভক্ত এবং ইউনিয়ন যুক্ত হলেও মানুষ নগর-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি বিষয়ে গত শনিবার রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহরসহ সারাদেশে সাড়ে ২৮ হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সাড়ে ১৭ হাজার। ঢাকার বাইরে অন্য জেলাগুলোতে সাড়ে ১০ হাজারের একটু বেশি। ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১৫৬ জনের, যার মধ্যে ঢাকাতেই ১২২ জন। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। ঢাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি সে তুলনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৬৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ শতাংশ নারী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশের সবকটি হাসপাতালে প্রায় ৬ হাজারের একটু বেশি ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন, যার মধ্যে ঢাকাতেই আছে ৩ হাজার রোগী এবং ঢাকার বাইরে আছে আড়াই হাজার। ঢাকা শহরে বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর পরিমাণ স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। কিন্তু ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এডিস মশার উপদ্রব বেড়েছে। শ্রীলঙ্কা ও মালয়েশিয়া প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। মশা নিধনে নিয়মিত ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এছাড়া গত ১০ দিনে ১ হাজার স্কুল-কলেজে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে। তবে এডিস মশা সিটি করপোরেশন একার পক্ষে নিমূল করা সম্ভব নয়। এতে জনগণের সহযোগিতা লাগবে। কারণ বাসাবাড়িতে জমে থাকা পানি সিটি করপোরেশনের পক্ষে পরিষ্কার করা সম্ভব নয়, নিজেদেরকেই পরিষ্কার করতে হবে।

ওষুধ ছিটিয়ে মাত্র ১০ ভাগ এডিস মশা নিধন করা সম্ভব- এমন মন্তব্য করে তিনি আরো বলেন, এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে বংশ বিস্তার করে। আর স্বচ্ছ পানি বাসাবাড়ি, অফিস-আদালতের কোনায় জমে, যেখানে মশা মারার ওষুধ ছিটানো সম্ভব নয়। সেজন্য সবাইকে নিজের জায়গাটুকু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে এডিস মশা জন্মবে না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম শফিকুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ডিএনসিসি এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় জমানো পানিতে লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি ফ্রিজের নিচে জমানো পানিতেও এডিসের লার্ভা মিলছে। এডিস মশা নিধনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে মসজিদের ইমাম ও স্কুলে স্কুলে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে বিভক্ত করা হয়েছে। এখানে নাগরিক সুযোগ-সুবিধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। ফলে এখন দুই সিটি করপোরেশনের কাজের ক্ষেত্রে সমন্বহীনতা দেখা যাচ্ছে। এক শহরে দুই ধরনের প্লানিং চলছে। বিভিন্ন উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে ঘাটতি থাকছে। নগর সম্প্রসারণের দরকার রয়েছে- এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটির আশপাশে ১৬টি ইউনিয়নকে ৩৬টি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে সিটি করপোরেশনে যুক্ত করা হয়েছে। অথচ অনেক ওয়ার্ডে যে রাস্তাঘাট রয়েছে, যা গ্রামাঞ্চলের চেয়েও বেহাল অবস্থা। সুতরাং, সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন ওয়ার্ড যুক্ত করার আগে গবেষণা করা হয়নি।

পুরান ঢাকার বাসিন্দা লিয়াকত আলী বলেন, ঢাকার দুই মেয়র প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ছুটে বেড়াচ্ছেন। রাজধানীতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়ত চলছেই। সেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বিতভাবে হচ্ছে না বলে দীর্ঘদিন থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে। নানা প্রতিষ্ঠানের নানা কাজ। বিষয়টি এমন- কোনটি থামিয়ে, কোনটি রাখি, কোনটা বাদ দিই? সবই দরকার। তাই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও গর্ত পূরণ অবিরত চলছেই, ধুলাবালি উড়ছে, রাস্তা বন্ধ হচ্ছে, পথচারীদের চলাচল স্বাভাবিক থাকছে না। ঘনবসতি এই নগরে হাজারও সমস্যা। ঘর থেকে বের হলেই কোনো না কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঘরে ফিরেও শান্তি খুব বেশি নেই। দিনের বেলায়ও মশা মানুষকে কামড়াতে ছুটে আসে। সন্ধ্যা হলে মশার উৎপাত ঠেকাতে কয়েলের ধোঁয়া জ্বালিয়েও সুফল হওয়া যাচ্ছে না।

এই মুহূর্তে কিউলেক্স মশার চেয়ে এডিস মশা মানুষকে আতঙ্কের মধ্যে রেখেছে। দুই সিটি করপোরেশন মশানিধনের ওষুধ ছিটালেও কিছুতেই মশার উপদ্রব কমাতে পারছে না। উন্নয়নের নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বহুতল ভবন নির্মাণকাজে ধুলাবালিতে বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠছে। এমনিতেই ঢাকার বায়ু দূষিত হয়ে পড়েছে। ঢাকা কিছুতেই যেন মানুষের নিরাপদ স্বাস্থ্যের বসবাসের জায়গা থাকতে পারছে না। নেই পর্যাপ্ত কমিউনিটি স্কুল-কলেজ, লাইব্রেরি-খেলার মাঠ ও পার্ক। ডিএসসিসি ১৮টি খাত এবং ডিএনসিসি ১৪টি খাতে সেবা দেয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিএসসিসি : রাস্তার বৈদ্যুতিক লাইট, হাসপাতাল, ডিএসসিসি হাসপাতাল, রাস্তা/নর্দমা/ফুটপাত, বাজার, জন্ম নিবন্ধন, ভস্মীকরণ সমাধির স্থান, ব্যায়ামাগার, কমিউনিটি সেন্টার, মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, রাস্তার গাড়ি পার্কিং, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা, গ্রন্থাগার, সঙ্গীত স্কুল, বাস টার্মিনাল, পাবলিক টয়লেট, পার্ক এবং খেলার মাঠবিষয়ক সেবা দেয়ার কথা রয়েছে।

ডিএনসিসি : রাস্তা খননের অনুমতি, নতুন হোল্ডিং নম্বর, হোল্ডিং ট্যাক্স সার্ভিস কার্যপ্রণালী, হোল্ডিংয়ের নামজারী, ডিএএমএফএ, ট্রেড লাইসেন্স ও নবায়ন পদ্ধতি, জন্ম সনদ, কবরস্থান ব্যবস্থাপনা, ধূমপান মুক্তকরণ নির্দেশিকা, যান-যন্ত্রপাতি ভাড়ার হার ও নিয়মাবলী, কমিউনিটি সেন্টার বুকিং, বহুতল ভবনের জন্য অনাপত্তিপত্র, জিআইএস ম্যাপ ক্রয়, উদ্যোক্তাদের সেবা কেন্দ্র। নগর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, খেলার মাঠ ও পার্ক ব্যবস্থাপনাও সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকলেও সেগুলোও ঠিকমতো পালিত হচ্ছে না।

ডিএসসিসি প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সিরাজুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ডিএসসিসির সঙ্গে যুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের বেহাল দশা কিছুটা নিরসন হয়েছে। এই অর্থবছরে এসব ওয়ার্ডের উন্নয়নকাজে নির্ধারিত বাজেটের চেয়েও অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তবে দৃশ্যমান কাজের জন্য বাসিন্দাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।