জাতীয় নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি

৩০০ আসনের বিপরীতে ৯শ’ প্রার্থীর তালিকা হাতে

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে। তারা ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিও সেরে নিচ্ছে। এদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজপথের রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকার পরিবর্তনের একদফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে নানা কর্মসূচি পালন করছে। আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপির নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনি ইশতেহার। এজন্য একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়েছে। তারা প্রাথমিকভাবে একটি খসড়া ইশতেহার তৈরি করে দলের হাইকমান্ডের কাছে পাঠাবে। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সারাদেশে ৩০০ আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দলটি। প্রতিটি সংসদীয় আসন থেকে তিনজনের নাম ঠিক করে ৩০০ আসনের বিপরীতে ৯০০ জনের নামের একটি তালিকা লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানোর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এ তালিকা থেকেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। তবে কোনো কোনো আসনে তিনজনের বেশি নামও থাকতে পারে। এদিকে গত বছরের আগস্টে সাবেক এমপিদের এলাকায় পাঠায় বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে জনসম্পৃক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন সাবেক এমপি এ প্রসঙ্গে বলেন, তাদের সঙ্গে লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অনলাইনে কথা বলে থাকেন। তিনি আন্দোলনের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিতে বলেছেন। যারা মাঠের আন্দোলনে সক্রিয় থাকবেন তারাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। লন্ডনে বসে সব তথ্যই তিনি নিচ্ছেন। তবে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বোচনে অংশগ্রহণ করবে না বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে দলটির বড় আপত্তি। তবে সব মিলিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে বিএনপি। জানা গেছে, ৩০০ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের আমলনামা পাঠানো হচ্ছে লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে। প্রার্থীদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় অবস্থান করার নির্দেশনাসহ কেন্দ্র থেকে দেয়া হচ্ছে নানা পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা। দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, বিএনপি বরাবরই নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন যখনই হোক না কেন, বিএনপির প্রার্থী দিতে কোনো বেগ পেতে হবে না। কারণ, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ৩০০ আসনে প্রায় হাজারখানেক প্রার্থীর নামের তালিকা তাদের কাছে রয়েছে। এর সাথে এবার কিছু যোগ-বিয়োগ হতে পারে। সেখান থেকেই রদবদল করে প্রার্থী ঠিক করা হবে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা’ এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির সিনিয়র এক নেতা বলেন, নির্বাচন নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। প্রস্তুতিরও কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থী আছেন। তবে নির্বাচনকালীন সরকার কে হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমরা আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। আমরা চাই, নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন।

এদিকে সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নে কোনোরকম আপস না করতে দলীয় নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের একদফা দাবিতে নিজের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়ে চলমান আন্দোলন আরো জোরদার করতে বলেছেন তিনি। সম্প্রতি বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই নেতা দেখা করতে গেলে খালেদা জিয়া তাদের মাধ্যমে এই বার্তা দিয়েছেন। আন্দোলন জোরদারে ব্যর্থ হলে দলীয় নেতাদের দায়িত্বে থাকা নিয়েও বিএনপি চেয়ারপারসন প্রশ্ন তুলেছেন বলে জানা গেছে। সূত্র জানায়, দলের শীর্ষ পর্যায়ের দুজন নেতা আলাদাভাবে খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় যান। তারা দলীয় চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার পাশাপাশি তাকে চলমান আন্দোলন ও সাংগঠনিক বিভিন্ন বিষয় অবহিত করেন। এ সময় খালেদা জিয়া নানা বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেন এবং দল ও আন্দোলন পরিচালনায় নানা নির্দেশনা দেন। বিএনপি ঘোষিত একদফার আন্দোলন সম্পর্কে খালেদা জিয়ার সাফ কথা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একদফা আন্দোলনে কোনো ছাড় নয়। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, তা আরো জোরদার করতে হবে।

সূত্র মতে, অনেকে মনে করেন বিদেশিদের মধ্যস্থতায় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার নিশ্চয়তা পেলেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি, সরকারে যেই থাকুক না কেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন তারা আর হতে দেবেন না। দলের নেতারা বলছেন, বিদেশি প্রতিনিধি দলসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তারা বোঝাতে চাইছেন যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতায় থাকাটাই বড় অন্তরায়।

নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচন করেই কয়েকবার ক্ষমতায় গেছে। তারা নির্বাচনের বিকল্প কিছু চিন্তা করে না। তবে তা হতে হবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আন্দোলন করে তা আদায় করার পর নির্বাচনের কথা সামনে আসবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, আমাদের কথা হলো- এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এই সরকারের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান বলেন, আমরা প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। আমরা এই সরকারের পতন ঘটিয়েই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব।

সূত্র মতে, এবার ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। সে কারণে ঢাকার গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় এবং নয়াপল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আগ্রহী প্রার্থীদের আনাগোনা বেড়েছে। গত নির্বাচনে যারা প্রার্থী হয়েছিলেন এবং যারা প্রার্থী হতে চেয়েও হতে পারেননি, তারা নিয়মিত গুলশান ও নয়াপল্টন কার্যালয়ে আসা-যাওয়া করছেন।

শুধু ঢ০কায় নয়, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা নিজ নিজ এলাকায়ও নির্বাচনি তৎপরতা চালাচ্ছেন। দলীয় কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি গণসংযোগ শুরু করে দিয়েছেন তারা। কৌশলগত কারণে সরাসরি ভোটের প্রচারে যেতে না পারলেও ঈদ, নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন দিবসে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি ব্যানার, বিলবোর্ড, পোস্টার লাগিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন। সদ্য অনুষ্ঠিত ঈদুল আজহায় বেশির ভাগ নেতা নিজের এলাকায় ছিলেন। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের চাঙা করতে এবং মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন আদায়ে স্বচেষ্ট প্রয়াস চালিয়েছেন তারা। গণসংযোগ, উঠান বৈঠক, কর্মিসভা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।

জানতে চাইলে টাঙ্গাইল-৭ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী বিএনপির শিশুবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী বলেন, আমরা এখন আন্দোলনে আছি। তার মানে এই নয় যে, নির্বাচনের প্রস্তুতি আমাদের নেই। দল যখনই সিদ্ধান্ত দেবে, তখনই আমরা নির্বাচনে যেতে পারব। আমাদের প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসেন। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে তার বৈঠক হয়। পাশাপাশি ঢাকায় আসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছয় সদস্যের নির্বাচনি অনুসন্ধানী মিশন। দুই সপ্তাহের সফরে, ইইউ প্রতিনিধি দলটি সরকার, রাজনৈতিক দলগুলো, নির্বাচন কমিশন, নিরাপত্তা কর্মকর্তা, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা কথা বলেন। তারা সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করেছেন।

প্রসঙ্গত, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল আর ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র সাতটি আসনে বিজয়ী হয়েছিল। তবে দুটি নির্বাচন নিয়েই ব্যাপক অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ ও নানা সমালোচনা রয়েছে। এজন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায় না বিএনপি।

উল্লেখ্য, সংবিধান অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন দেশের মানুষের কাছে এখন আলোচনার শীর্ষে।