লরি থেকে ছিটকেপড়া কনটেইনার চাপায় থামছে না মৃত্যু

চট্টগ্রামে বন্দর এলাকার সড়ক যেন মরণ ফাঁদ

প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানাধীন সড়কগুলো পরিণত হয়েছে মরণ ফাঁদে। বন্দরে প্রতিদিন জাহাজ থেকে নামানো হয় আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার। আবার জাহাজে তোলার জন্য নেয়া হয় রপ্তানি পণ্যভর্তি কনটেইনার। এসব কনটেইনারের কোনোটি ৪০ ফুট দীর্ঘ। কোনোটি ২০ ফুট দীর্ঘ। ঝুঁকিপূর্ণভাবে এবং নিয়ন্ত্রণহীন চলাচলের কারণে কনটেইনারগুলো লরি থেকে ছিটকে পড়ছে যাত্রীবাহী সিএনজি টেক্সি কিংবা রিকশার উপর। এতে মুহূর্তেই ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। গেল মে মাসে লরি থেকে ছিটকেপড়া কনটেইনার গিয়ে পড়ে রিকশারোহী পিতাপুত্রের রিকশার উপর। এতে কোনোমতে রিকশাচালক প্রাণে বাঁচলেও আরাহীরা নিহত হয়। সর্বশেষ ২৬ জুলাই রাতে লরি থেকে ছিটকেপড়া কনটেইনার গিয়ে পড়ে একজন ট্রাফিক পুলিশের উপর। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় ওই পুলিশ সদস্য। বন্দর থানা সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানাধীন কাস্টম ব্রিজ এলাকায় ট্রেইলরচাপায় এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। নিহত নূরে আলম বন্দর ডিভিশনের ট্রাফিক কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মজলিশপুর এলাকায়। এ ঘটনায় ট্রেইলরের চালক ও হেলপারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- ট্রেইলরচালক শামীম খান (২৮) ও হেলপার মো. সেলিম ওরফে লিটন (৩৬)। শামীম খান বাগেরহাট জেলার মোরলগঞ্জ থানার আব্দুস সালামের ছেলে ও সেলিম ফেনী জেলার সোনাগাজী থানার মো. মুছলিমের ছেলে। বুধবার (২৬ জুলাই) দিবাগত রাত সোয়া ১২টায় রাতে নগরীর কাস্টম ব্রিজ এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, বুধবার রাতে কাস্টম ব্রিজ এলাকায় একটি বেপরোয়া ট্রেইলর গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে কাত হয়ে যায়। এ সময় গাড়ির ওপর থাকা একটি পণ্যভর্তি কনটেইনার দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্য নূরে আলমের ওপর পড়ে। খবর পেয়ে বন্দর থানা পুলিশ র‌্যাকার দিয়ে একঘণ্টা চেষ্টার পর কনটেইনার সরিয়ে তাকে উদ্ধার করে। পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তবে স্থানীয়রা তাৎক্ষণিক ট্রেইলরটি আটক করলেও চালক ও হেলপার পালিয়ে যায়। পরে গাড়িটি তল্লাশি করে শামীম খানের নামে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়। পুলিশ পরে যাচাই করে জানতে পেরেছে লরিটি চালাচ্ছিল হেলপার। নিয়ম বহির্ভুতভাবে ট্রেইলর চালানোর কারণে ঘটেছে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা।

মাত্র তিন মাস আগে গেল ১০ মে দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর ইপিজেড এলাকায় চলন্ত লরি থেকে ছিটকেপড়া কনটেইনার চাপায় রিকশা আরোহী পিতা-পুত্রের মর্মামন্তিক মৃত্যু হয়েছে। ওই দিন বেলা পৌনে ১২টায় নগরীর ইপিজেড থানার স্টিলমিল বাজারের খালপাড় রোডের সামনে মূল সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন, মো. ইউনুছ মিজি (৫৯) ও তার ছেলে আব্দুর রহিম মিজি (৩০)। তাদের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। ইউনুছ মিজি খাদ্য বিভাগের অধীন চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সাইলো অপারেটিং জেটিতে কর্মরত ছিলেন। কনটেইনার চাপা পড়ে রিকশাচালক মোরশেদ আলম (২৭) গুরুতর আহত হয়েছেন। তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার পর সুস্থ হন।

নগর পুলিশের বন্দর জোনের উপ-কমিশনার শাকিলা সোলতানা জানান, পণ্যবোঝাই কনটেইনার নিয়ে একটি লরি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নগরীর পতেঙ্গা থানার কাটগড় এলাকায় এসএপিএল কনটেইনার ডিপোতে যাচ্ছিল। লরি চালাচ্ছিলেন সাজ্জাদ হোসেন। দ্রুতগতিতে লরিটি এগিয়ে যাবার সময় স্টিলমিল বাজারের খালপাড় রোডের সামনে মূল সড়কে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের নিচে একটি কনটেইনার ছিটকে পড়ে যায়। ছিটকেপড়া কনটেইনারটির নিচে চাপা পড়ে সড়কে চলাচলরত একটি রিকশা। ওই রিকশার আরোহী ছিলেন ইউনুছ ও তার ছেলে আব্দুর রহিম। রিকশাটি চ্যাপ্টা হয়ে যায়। কনটেইনারের নিচে চাপা পড়া অবস্থায় মারা যান বাবা ও ছেলে। তবে রিকশা চালক মোবারক লাফিয়ে পড়ে প্রাণরক্ষা করলেও গুরুতর আহত হন।

উপ-পুলিশ কমিশনার শাকিলা আরো জানান, ঘটনার পর পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের টিম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এ সময় সেখানে শত শত উৎসুক জনতার ভিড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করে। ফায়ার সার্ভিসের টিম বন্দরের সহায়তায় একটি শক্তিশালী ক্রেন দিয়ে কনটেইনারটি সরিয়ে নিয়ে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করে। তাদের কাছের নৌবাহিনী হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশ জানায়, এ ধরনের কনটেইনার পরিবহনের সময় লরির সঙ্গে চার কোনায় চারটি লক করা হয়। আবার নিরাপত্তার স্বার্থে লোহার শিকল দিয়ে কনটেইনারটি লরির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। কিন্তু এই কনটেইনারে এমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ৪০ ফুটের লরিতে ২০ ফুট দৈর্ঘের কনটেইনারটি অনিরাপদভাবে বন্দর থেকে ডিপোতে নেওয়া হচ্ছিল। এই কারণে ভাঙা রাস্তায় ঝাঁকুনিতে পণ্যবোঝাই ভারি কনটেইনারটি ছিটকে পড়ে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।