ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার ভোগাই-কংস নদী খনন

* ভাগ্য বদলাবে এলাকাবাসীর * সচল হয়েছে ১৩৫ কিমি. নৌপথ
ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার ভোগাই-কংস নদী খনন

একসময় নৌপথই ছিল আবহমান বাংলার চলাচলের একমাত্র ভরসা। কালের চক্রে খাল-নদী-বিল-বাঁওড় দখলে নিয়ে মানুষ তার গতি পদে বাধার সৃষ্টি করে। ফলে, জলবায়ু পরিবতর্নের পাশাপাশি প্রকৃতিতে নেমে আসে দুর্যোগ। খরা অতিবৃষ্টিতে ফসলহানি যেমন ঘটছে, তেমনি প্রাকৃতিক ভারসাম্যে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। অবশেষে বর্তমান সরকার প্রাকৃতিক একই সঙ্গে পরিবেশের দিকে লক্ষ্য রেখে নদী খননের মতো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়। ‘ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য লহ এ নগর’ সে পথে না হেটে নগরও প্রকৃতিকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে গঠন করেছে নদীরক্ষা কমিশন। তারই ফসল নদী বাঁচাও দেশ বাঁচাও স্লোগান। সেই প্রকল্প অনুযায়ী সরকার সাম্প্রতিক সময়ে ময়সনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলার কংস ও ভোগাই-কংস নদী ড্রেজিং করে এলাকার তিন উপজেলার মানুষের ভিতরে স্বস্তি এনে দিয়েছে। যা এলাকার জন্য বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। সরকার দেশজুড়ে মরা নদীগুলো চিহ্নিত সারাবছর নৌপথ সচল রাখার জন্য বিভিন্ন খনন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২১৩ কিলোমিটার নৌপথ খননের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। শুস্ক মৌসুমে যেসব নৌপথ নৌ চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে সেসব নৌপথ খনন করে তা আবার চলাচল উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ১৩৫ কিলোমিটার নৌপথের চলাচল সচল হয়েছে। নৌপথের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৫৫টি হাটবাজার। এছাড়া নদী খননের মাটি (বর্জ্য) দিয়ে ২০২ বিঘা অকৃষি জমিকে কৃষি জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। বিশেষ করে বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ ও নেত্রকোণা সদর এই তিন উপজেলায় এখন সুদিন ফিরে এসেছে। জানা গেছে, সীমান্তের ওপারের ভোগাই কংস শেরপুর জেলার অন্তর্গত নালিতাবাড়ী উপজেলার মধ্যদিয়ে ভোগাই হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এটি একই উপজেলায় ইছামতি এবং কংসতে বিভক্ত হয়ে ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর উপজেলায় পুনরায় মিলিত হয়ে, পরবর্তী ভোগাই কংস নামে গাগলাজোর এলাকায় ধনু নদীতে মিশেছে। কিন্তু কালোক্রমে নদী ভরাট হয়ে যায়। পরবর্তীতে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) পরীক্ষার নিরিক্ষার পর কংস ও ভোগাই-কংস নদী খননে দায়িত্ব পান নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ড্রেজিং বিভাগ। পরে বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং বিভাগ ভোগাই-কংস নদীতে পাঁচটি প্যাকেজে খনন কার্যক্রম গ্রহণ করে। খনন কার্যক্রম পাঁচটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দ্বারা খনন কাজ সম্পাদিত হয়। সিইজিআইএস খনন কাজের ডিজাইন ও এলাইনমেন্ট এবং খননকার্য পরিবীক্ষণ করে। টেকসই এলাইনমেন্ট ও ডিজাইন প্রদানে নদীর মরফোলজিক্যাল বেশিষ্ট্য পর্যালোচনা করা হয়। সিইজিআইএস মাঠপর্যায়ের প্রতিনিধিরা সার্বক্ষণিক মাঠ পর্যায়ে থেকে ডিজাইন ও এলাইনমেন্ট এবং খনন কার্যক্রম মনিটরিং করে খননকৃত মাটির পরিমাণ নির্ণয় করা হয়। খননকার্য পরিবীক্ষণ ও খননকৃত মাটির পরিমাণ নির্ণয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিকভাবে করা হয়েছে এবং সরকার বা রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয় এমন কাজ খনন কাজে করা হয়নি বলে সিইজিআইএস পর্যবেক্ষণ টিম সূত্রে জানা গেছে।

নদী খননের ফলাফল : খননকৃত নদীর নাব্যতা ও প্রবাহি ক্ষমতার উন্নয়ন হয়েছে। সে অনুযায়ী নৌযান চলাচল উক্ত নৌপথ ব্যবহারকারী যাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। ড্রেজিং করার ফলে মোট ১৩৫ কিলোমিটার নৌপথে নাব্যতার উন্নয়ন হয়েছে। ফলে নদীর উভয় তীরের প্রচুর অনাবাদী জমি সেচের আওতাধীন হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞমহল। তারা আরো জানান, এই নৌপথের নাব্যতা উন্নয়নের ফলে প্রায় ৫৫টি হাটবাজার উল্লেখিত নৌপথের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। বাজারগুলো নৌপথের সাথে সংযুক্ত হওয়ার ফলে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য স্বল্প খরচে বাজারজাত করতে পারছে বলে সরেজমিন অসনুসন্ধানে জানা গেছে।

জানা গেছে, ড্রেজিং করার পর এই নদী দিয়ে মালবাহী কার্গো, লঞ্চ, ট্রলার নৌকা সহজেই চলাচল করতে পারে যা নৌযান চলাচল ও পণ্য পরিবহণকে অনেক সহজীকরণ করেছে বলে স্থানীয়রা জানান। ড্রেজিং করার বর্জ্য ব্যবহার করে ফুলপুর ঠাকারবাখাই খেলারমাঠ, জৈনপুর ও দোবাইল হাওর বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। সেচের পানির প্রাপ্যতা বৃদ্ধির কারণে ফসলের চাষাবাদ ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্থানীয় কৃষকরা জানান।

স্থানীয় জেলেরা জানান, নদীতে মাছের পরিমাণ বেড়েছে এবং জেলেরা উপকৃত হচ্ছে। নদীতে পানি প্রবাহ সারা বছর হওয়ার মৎসজীবী মানুষ পুরোনো পেশায় ফিরে এসেছে এবং সামাজিক মূল্যবোধ বেড়েছে.০ যা আর্থিক মূল্যমানে হিসাব করা কঠিন। ড্রেজিং করা উপকরণ দিয়ে নিচু জমি যেমন ডোবা, পুকুর ইত্যাদি উন্নয়ন করার ফলে জমির মূল্য প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। এছাড়া সারা বছর পানির সহজলভ্য হওয়ার কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে নদীতে ড্রেজিং করার কারণে পানি নিষ্কাষণ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে ফলে উভয় তীর বন্যামুক্ত হয়েছে বলে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জানান।

এ বিষয়ে নেত্রকোনার পূর্বধলা থানার পূর্ব ইদ্রা গ্রামের বাসিন্দা এখলাস উদ্দিন (৬০) বলেন, আমি ৩১ বছর যাবৎ খেয়া পারাপারের কাজ করি। দুই বছর আগে নদী শুকিয়ে যেত। তখন দুইমাস খেয়া পারাপার বন্দ থাকত। নদী খননে ফলে নদীতে পানি আছে। নদীর দুই তীরে উঁচু হয়েছে। শর্চাপুর ব্রীজ হতে জারিয়া পর্যন্ত নদী খনন করে গ্রামের নিচু জায়গা ভরাট করা হয়েছে। ফলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। এর ফলে রাস্তাঘাট, স্কুল, মাঠসহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে এবং নদীতে এখন মাছও পাওয়া যাচ্ছে বলে এখলাস জানান। পূর্বধলা থানার কাসিমালা গ্রামেরবাসীন্দা মিরাজ আলি (৯৫) বলেন, নদী খননের পূর্বে এই কংস নদীতে পানি থাকতো না। নদীর তলদেশ ধু ধু করত। নদী খননের কারণে পানি পাচ্ছি। নদী খননের আগের কাঠাপ্রতি জমির দাম ছিল ২৫ হাজার টাকা। নদী খননের ফলে কাঠাপ্রতি জমির মূল্য ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা হয়েছে। এছাড়া এই নদীর পানি দিয়ে কৃষিকাজও হয় বলে তিনি জানান। পূর্বধলা থানার পাটয়া গ্রামের বাসিন্দা বাঁধন (১৯) বলেন, কংস নদী খননের পূর্বে নদী শুকনা ছিল। হেঁটে নদী পার হওয়া যেত। নদী খনন করার ফলে এখন নদীতে পানি থাকে। বর্তমানে নদীতে ১০ ফিট পানি আছে। পূর্বে বর্ষা মৌসুমেও নদীতে পানি থাকত না বতর্মানে নদী খনন করার ফলে শুকনো মৌসুমেও পানি থাকে। ফলে কৃষিতে সেচ দিতে পারি। নদী খননের পূর্বে বর্ষা মৌসুমে বাড়িঘর বন্যার পানিতে ডুবে যেত। বর্তমানে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি এবং পাড়ের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বন্যা হয় না বলে বাধন জানান। এরপর কথা হয় ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার ট্যাংগাটি গ্রামের বাসিন্দা চান মিয়া (৭৫), ইসলাম উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা বসির উদ্দিন, হেলাল উদ্দিন বিশ্বাস, উকিল চন্দ্র বিশ্বাস, মো. মামুন বিশ্বাসসহ বিভিন্ন এলাকাবাসীর সঙ্গে। তারা জানান, কংস ও ভোগাই-কংস নদী এক সময় ভরাট ছিল। কোন নৌযান চলাচল করতে পারতো না। বর্তমান সরকার নৌপথের গুরুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে খনন প্রকল্প গ্রহণ করে। ফলে মৃত নদী এখন সচল হয়েছে ৮ থেকে ১০ ফিটের গভারতা পানি রয়েছে। বিভিন্ন প্রকার নৌযান চলচাল করতে পারছে। সার্বিক ভাবে এলাকার উন্নয়ন হয়েছে বলে সরেজমিন এলাকাবাসী জানান। এ অবস্থা দূর করার জন্য ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে রাজধানীর বৃত্তাকার নৌপথ চালুকরণ প্রকল্প, দাউদকান্দি ও হরিদাসপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প, অভ্যন্তরীণ নৌপথের ৫৩টি রুটে ক্যাপিটাল ড্রেজিং (১ম পর্যায় : ২৪টি নৌপথ) প্রকল্প, পুরোনো ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, পুনর্ভবা ও তুলাই নদী ড্রেজিং প্রকল্প, মোংলা হতে চাঁদপুর ভায়া গোয়ালন্দ হয়ে রুপপুর পর্যন্ত নৌ পথ প্রকল্প কার্যক্রম গ্রহণ করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধিন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এসব খনন প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিং করে গত ১৪ বছরে (২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) ৮ হাজার ৫০০ কিলোমিটার (বর্ষা মৌসুমে) নৌপথ খনন করা হয়। শুস্ক মৌসুমে নৌপথের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৬ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার। এছাড়া নতুন সংযোগসহ গত বছর ৩০ জুন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৫৮ কিলোমিটার নৌপথে সারাবছর নৌযান চলাচল স্থায়ী হয়। ড্রেজিং এর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ। খনন কৃত এসব নৌপথের সর্বনিম্ন পানির গভীরতা দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫০ মিটার। এ বিষয়ে সম্প্রতি সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে নৌপরিহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, সারাবছর নৌপথ সচল রাখতে খনন কাজ আমরা অব্যাহত রাখতে পেরেছি। ড্রেজিংয়ের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং বিভাগ। খননকৃত নৌপথে নৌযান চলাচল করতে পারছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত