ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সংস্কারের জন্য বন্ধ কালুরঘাট সেতু

পানিতে ডুবছে পন্টুন পারাপারে চরম দুর্ভোগ

পানিতে ডুবছে পন্টুন পারাপারে চরম দুর্ভোগ

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত পুরোনো কালুরঘাট সেতু বন্ধ করার দিনই অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছেন দুই পাড়ের কয়েক লাখ বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার সকালের দিকে সেতু বন্ধ করার পর পরই চালু করা হয় ফেরি। কিন্তু ফেরিতে চলাচল করতে বিড়ম্বনায় পড়েন বাস, টেম্পো, ট্রাক, মোটর সাইকেল চালকরা। কয়েক দিনের বর্ষণে ফুলেফেঁপে উঠেছে কর্ণফুলী নদী। এতে ফেরিতে উঠানামার মাধ্যম পন্টুন জোয়ারের পানিতে ডুবছে। ওই সময় ফেরি ভিড়লে পন্টুনের সাথে যুক্ত এপ্রোচ সড়কটি কোমর পানিতে ডুবে যায়। এতে যানবাহনগুলো অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায় ফেরি থেকে মূল সড়কে পৌঁছে। আবার মূল সড়ক থেকে ফেরিতে ওঠার সময় ডুবে যায় সব ধরনের যানবাহন। এভাবে চরম দুর্ভোগে গতকাল বুধবার দ্বিতীয় দিন পার করেছে সেতু এলাকার দুই পাড়ের মানুষ। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কালুরঘাট সেতু সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু মেরামতকাজ কোনোভাবেই বর্ষা মৌসুমে শুরু করা ঠিক হয়নি। কারণ, ফেরি সার্ভিসের গুরুত্বপূর্ণ পন্টুন ভরা জোয়ারে ডুবে থাকে। এ সময় যানবাহন পার হওয়া কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। মেরামত কাজ শুষ্ক মৌসুমে শুরু না করায় দুর্ভোগ বেশি হচ্ছে।

গতকাল সরেজমিন দেখা যায়, এপ্রোচ রোডে গাড়ি চলছে অর্ধেক ডুবন্ত অবস্থায়। দুই পাড়ে অপেক্ষমান গাড়ির দীর্ঘ সারি। শিশু ও মহিলা যাত্রীরা পার হতে থাকেন ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। কারণ, ভরা জোয়ারে দুর্ঘটনায় নদীতে পড়লে রক্ষা নেই। প্রয়োজনের তুলনায় ফেরি কম হওয়ায় অপেক্ষমান যানবাহনের দীর্ঘ সারি সব সময় চোখে পড়ছে।

সওজ সূত্র জানায়, ফেরিতে পারাপারে টোল হার নির্ধারণ হয় আগেই। কিন্তু চার দফা টেন্ডার দিয়েও টোল আদায়েরের ইজারাদার পাওয়া যায়নি। ফেরি পারাপারে এখন অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। এখন সওজ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় টোল আদায় করছে। সওজের জনবল কম। তাই একেবারে গাড়ির কাছে গিয়ে টোল আদায় করতে পারছে না। গাড়ির চালক বা হেলপারকে গাড়ি লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্দিষ্ট কাউন্টারে গিয়ে টোল দিতে হচ্ছে। এর ফলে ফেরিতে ওঠার আগে গাড়ির দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। গত মঙ্গলবার সেতু বন্ধ হওয়ার পর ফেরি সার্ভিস চালুর সাথে সাথে উভয় পাড়ের যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। অ্যাপ্রোচ রোড কাদামাটিতে একাকার হয়ে যায়। কর্মজীবীরা দুর্ভোগ মাড়িয়ে কর্মস্থলে পৌঁছেন। জোয়ারের পানিতে অ্যাপ্রোচ রোড তলিয়ে যাওয়ায় সিএনজি ট্যাক্সি, মোটরসাইকেল নষ্ট হয়ে পানিতে আটকা পড়ে। অনেককে দেখা গেছে গাড়িগুলো ঠেলে উপরে তুলতে। গত মঙ্গলবারের চিত্র গতকালও দেখা যায়।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, প্রথম দিন ফেরি চালু নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়। দুটি ফেরি চালুর কথা থাকলেও একটির চালক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এতে ওই ফেরি চালু করা সম্ভব হয়নি। আমরা দুর্ভোগ কমিয়ে চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি তিনটি ফেরি যাতে সব সময় সচল থাকে।

এদিকে কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু চালু না হওয়ায় বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়া উপজেলার একাংশের লোকজনের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। নতুন সেতুর জন্য অর্ধ শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করছে লাখ লাখ বাসিন্দা। কিন্তু প্রতিশ্রুত নতুন সেতু আর হয়নি। ইতিমধ্যে পুরোনো কালুরঘাট সেতুর বয়স শত বছর পূর্ণ হয়েছে। এখন একেবারেই জরাজীর্ণ অবস্থা। লোকজন সব সময় শঙ্কার মধ্যে থাকেন সেতুটি কখন ভেঙে পড়বে।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে সামরিক প্রয়োজনেই মূলত কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সেনা চলাচলের জন্য একটি সেতুর প্রস্তাব জোরেশোরে আলোচনা হয়। এরপর ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানির ব্রিজ কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেতুটি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করে। প্রথমে ট্রেন চলাচলের জন্য ৬৩৮ দশমিক ৫ মিটার দীর্ঘ সেতুটি কর্ণফুলী নদীতে ছয়টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টিল পিলার, দুটি এবটমেন্ট ও ১৯টি স্প্যান দিয়ে নির্মাণ করা হয়। ১৯৩০ সালের ৪ জুন সেতুটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। রেলসেতু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্যদের ব্যবহৃত মোটরযান ও যুদ্ধযান চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৫৮ সালে এসে সেতুটিতে সব ধরনের যান চলাচল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এরপর থেকে ট্রেনের পাশাপাশি অন্য যানবাহনগুলো চলাচল করছে।

নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। লোকজনের অভিযোগ উদ্যোগটি বাস্তব রুপ লাভ করছে না। ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর কালুরঘাটে রেল-কাম সড়ক সেতু নামে একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) তৈরি করে রেলওয়ে পূর্বা ল কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটি যাচাই বাছাই শেষে কয়েক দফা পুনর্গঠন করা হয়। কিছুটা ত্রুটির কারণে প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। পরে এই সেতুর একটি চূড়ান্ত ডিজাইন দাঁড় করানো হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল প্রজেক্ট প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি প্রকল্পের অধীনে কর্ণফুলী নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রকল্পটি যুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে কালুরঘাটে অবস্থিত পুরোনো রেল সেতুর স্থলে নতুন রেলওয়ে কাম রোড সেতু নির্মাণের নকশা প্রণয়ন করা হয়। এ ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত দ্য ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) সাথে রেলওয়ের চুক্তি হয়। শূন্য দশমিক ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির উপর দুটি রেলসড়ক দিয়ে ডিজাইন করা হয়। পরে কোরিয়ার অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের আপত্তির কারণে একটি রেল সড়ক যুক্ত করে নতুন ডিজাইন তৈরি করা হয়। প্রস্তাবিত নকশায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেতুর উচ্চতা ধরা হয় ৭ দশমিক ৬২ মিটার বা প্রায় ২৫ ফুট। কিন্তু এই উচ্চতায় ব্যাপারে আপত্তি জানায় বিআইডব্লিউটিএ। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেতুর যে উচ্চতার কথা বলা হয়েছে, তাতে নেভিগেশন চ্যানেল হুমকির মুখে পড়বে। সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার বা ৪০ ফুট করার শর্ত দেয় এই সংস্থা। এখন বলা হচ্ছে সেতু নির্মাণের কাজ অনেক এগিয়েছে। সহসা মূল কাজ শুরু হবে।

কালুরঘাট পূর্ব পাড়ের বাসিন্দা এমরান হোসাইন বলেন, আমরা সেই ছোট বেলা থেকে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে শুধু প্রতিশ্রুতি শুনে আসছি সেতুটি নির্মাণের। আর এখন বড় হয়ে কর্মজীবনে পৌঁছেও সেতুর দেখা পাচ্ছি না অর্থাৎ নতুন সেতু দেখছি না। জানি না, এখানে আদৌ নতুন সেতু হবে কি না। আমরা একেবারেই হতাশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত