ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শয্যা-আইসিইউ সংকট চরমে

স্বাস্থ্য খাতের বেহালদশা
শয্যা-আইসিইউ সংকট চরমে

স্বাস্থ্য খাতে হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স ও বিভিন্ন উন্নতমানের যন্ত্রাংশের ব্যবস্থা করা হলেও হাসপাতালগুলোর বেহাল অবস্থা চোখে পড়ছে। হাসপাতালে বেড ও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সংকট নিরসন কোনোভাবেই যেন সম্ভব হচ্ছে না। ডাক্তার আছেন তো নার্স নেই। নার্স আছেন তো যন্ত্রপাতি নেই। যন্ত্রপাতি থাকলে বিকল পড়ে আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে নতুন যন্ত্র বছরের পর বছর বাক্সবন্দি রাখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতে এমন খামখেয়ালিপনার মাশুল দিচ্ছে মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনা মহামারির পরও স্বাস্থ্য খাতে খামখেয়ালিপনা অব্যাহত থাকায় ডেঙ্গুতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও তার স্বজনরা। দূরদর্শিতার অভাবে করোনা মহামারির মতো একই চিত্র দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুতে। করোনা মহারিতে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাসপাতালে বেডের সংকট চরম আকার ধারণ করেছিল। ফলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্মিত বহুতল মার্কেটকে কোভিড হাসপাতাল করা হয়। এবার ডেঙ্গুতে হাসপাতালে বেড সংকট দেখা দেওয়ায় ওই মার্কেটে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পরিকল্পনার অভাবে বছরের পর বছর স্বাস্থ্য খাতে বেহাল অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের চার তলায় ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানে প্রতিটি বেডে রোগী রয়েছে। বেড ফাঁকা না থাকায় ফ্লোরে প্লাস্টিকের পাটি বিছিয়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কর্মরত চিকিৎসকরা বলেছেন, দিনে দিনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আগামী এক সপ্তাহে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা কঠিন। এখনই রোগীদের শয্যা দিতে পারছি না। তিনি বলেন, এই হাসপাতালে আরো চিকিৎসক ও নার্সের দরকার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোগীর স্বজন বলেন, আমার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ। দ্রুত প্লাটিলেট নেমে যাচ্ছে। শরীরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খুবই উদ্বিগ্নে আছি। আইসিইউতে শয্যার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু খালি নেই। চোখের সামনে স্ত্রীর অসহ্য যন্ত্রণা দেখছি। কিন্তু কিছু করার নেই। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে। হাসপাতাল এখন রোগীতে পূর্ণ।

দেশে সব সরকারি হাসপাতালের অবস্থা কম-বেশি প্রায় একই রকম। ডাক্তার আছে তো নার্স নেই। নার্স আছে তো যন্ত্রপাতি নেই। আবার যন্ত্রপাতি থাকলে বিকল পড়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে নতুন যন্ত্র বাক্সবন্দি রাখছে বছরের পর বছর। সরকারি হাসপাতালে রোগীর স্বজনদের মানসিক ও চাপ সৃষ্টি করে বেসরকারি পাসপাতালে পাঠানো। স্বাস্থ্যসেবার নামে এভাবে রমরমা বাণিজ্য খুলে বসেছে। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে স্বাস্থ্য খাতের অনেক উন্নতি হয়েছে। এতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক, হাসপাতাল কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী, নার্স ও চিকিৎসকদের অতিরিক্ত লোভ-লালসার কারণে স্বাস্থ্য খাতের সব অর্জনকে অনেকটাই মøান করে দিচ্ছে। মানুষ যে পরিমাণ ট্যাক্স দেয়, সেই তুলনায় সেবামান পাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে অনিয়ম, দুর্নীতি, দালালের দৌরাত্ম্য ছাড়াও চিকিৎসক, নার্স ও যন্ত্রপাতির ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ হাসপাতাল নোংরা-অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকার কারণে মানুষের আস্থা কম। অনেকে বাধ্য হয়েছে দেশের বাইরে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে বাধ্য হচ্ছে।

চলতি বছরের মে মাসে এক রিট আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মোহাম্মদ শওকত আলী চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশে চিকিৎসকরা মুনাফা করছেন। সবকিছুরই একটা সীমা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব সময় কেনাকাটার জন্য প্রস্তুত। একমাত্র আল্লাহই জানেন ওই কেনাকাটায় কী থাকে।

আপনারা ১৭ কোটি মানুষের টাকা খাচ্ছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং কারা মহাপরিদর্শকের আইনজীবীদের হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেন, আপনারা কতজনের কাছে ক্ষমা চাইবেন? আপনারা যদি পরকালে বিশ্বাস করতেন তবে চুরি করতে পারতেন না।

কারাবন্দিদের যথাযথ চিকিৎসার জন্য সারাদেশের কারাগারে ডাক্তার নিয়োগের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে করা আবেদনটি সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী জেআর খান রবিন ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থে মামলা হিসেবে দায়ের করেন। বিচারপতি কামরুল কাদের বলেন, এ দেশের সন্তান হিসেবে আমরা অনেক কিছুই জানি। আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম, যা দেখেছি তা বিদেশের একটি ছোট হাসপাতালের চেয়েও খারাপ। এই বিচারপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এলাকার কাছাকাছি হলেও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছে।

এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালগুলোতে সেবার মান ও রোগীর চাপ বেশি থাকায় রোগীরা ঠিকভাবে সেবা পান না।

এছাড়া সরকারি হাসপাতালগুলোতে জনবল বৃদ্ধি ও সেবার মান উন্নত করতে হবে। উন্নত সেবার আশায় রোগীর স্বজনরা সরকারি হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেট হাসপাতালে সেবা নিতে যান। এছাড়া সরকারি হাসপাতালে কর্মরত কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দালালদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। তারা রোগী ও তাদের স্বজনদের ভুল বুঝিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বদলি করতে হবে।’

চাঁদপুর : গত ২৪ ঘণ্টায় ৪৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। হাসপাতালের বিছানায় জায়গা না পেয়ে ফ্লোরে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। গতকাল চাঁদপুর ২৫০ শয্যা সরকারি জেনারেল হাসপাতালে নিয়মিত রোগীর পাশাপাশি ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসা নেন।

তবে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা ওয়ার্ড থাকলেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নির্দিষ্ট কক্ষের বাহিরে চিকিৎসা নিতে দেখা গেছে। চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহবুবুর রহমান বলেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতার অভাব নেই।

রাজশাহী : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের রিপোর্টে দেখা গেছে, গত বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় ২০ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। আগে ভর্তি ছিলেন ৬৫ জন রোগী।

এতে মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫ জনে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ বলেন, রামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহের চেয়ে আগস্টের শুরুতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরো বেশি। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য হাসপাতালের একটি বিশেষায়িত টিম এখন কাজ করছে। মজুত রাখা হয়েছে ওষুধপত্রও। তবে ক্রমবর্ধমান হারে রোগী বাড়তে থাকলে রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় হিমশিম খেতে হবে।

খুলনা : খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে ৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ২২ জন। তথ্যটি নিশ্চিত করেন খুমেক হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার। তিনি বলেন, চলতি বছরে খুমেকে সর্বমোট ৪০২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।

গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২২ জন ভর্তি হয়েছেন। ছাড়পত্র নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১৬ জন। তবে গত বুধবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (এমআইএস) পরিচালক অধ্যাপক শাহাদত হোসেন বলেন, ঢাকার ডেঙ্গু আক্রান্তের হার মোটামুটি স্থিতিশীল, তবে ঢাকার বাইরে আক্রান্তের হার বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর ভর্তির জন্য বেডের সংকট নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত