ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রতিদিনই মরছে মানুষ

গ্রামীণ জনপদেও বাসা বেধেছে শহরের ডেঙ্গু

রোগীর চাপ বাড়ছে রাজধানীতে
গ্রামীণ জনপদেও বাসা বেধেছে শহরের ডেঙ্গু

রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে প্রতিনিয়ত এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুজ্বর হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে, সারাদেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ আগে বলা হতো ডেঙ্গু ঢাকা কেন্দ্রিক। আর এখন সারা দেশেই উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী ঢাকার বাইরের। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চলতি বছরই প্রথম ঢাকার চেয়ে বাইরের জেলাগুলোয় ডেঙ্গু রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ, এডিস মশা নিধনে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের তৎপরতা কিছুটা লক্ষ্য করা গেলেও গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল সিটি করপোরেশন, সব পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পর্যায় মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। যত্রতত্রে পানি জমছে। যার কারণে শহরের সঙ্গে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা।

গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ মো. জাহিদুল ইসলামের সই করা ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৪৯৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৪৯৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা এক হাজার ৬৯ জন ও ঢাকার বাইরের এক হাজার ৪২৬ জন। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১০ জনের মধ্যে সাতজন ঢাকার বাসিন্দা। তিনজন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৬৩ হাজার ৯৬৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৩৪ হাজার ৫২৩ জন। ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ২৯ হাজার ৪৪৫ জন। একই সময়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন ৫৪ হাজার ৩৩১ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৯ হাজার ৬০২ জন এবং ঢাকার বাইরের ২৪ হাজার ৭২৯ জন।

সবার সমন্বিত উদ্যোগে এডিস মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশজুড়ে দুই প্রজাতি এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায়। এরা এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটস। ঢাকা থেকে শুরু করে সারা দেশে ডেঙ্গুর বাহক এসব এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে ঢাকায় এডিস মশার লার্ভা নিয়ে জরিপ হলেও সারাদেশে জরিপ হয়নি। এখন দেশজুড়ে এডিস মশার লার্ভা জরিপ করতে হবে। কারণ কোনো রোগের বিস্তার ঘটলে, সেটির প্রতিকারের আগে জরিপের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এলোমেলভাবে এডিস মশা নিধনে কাজ করলে আগামীতেও মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে ভুগবে।

জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টম্বরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার বর্ষাকালীন মশা জরিপ করেছে। সেই জরিপে- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার ১৩ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা বা শূককীট পাওয়া গেছে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে পাওয়া গেছে প্রয় ১২ শতাংশ বাড়িতে। দুই সিটি মিলিয়ে রাজধানীর ১২ শতাংশের বেশি বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। এডিসের লার্ভার সেই জরিপের প্রভাব পড়েছে জুন, জুলাই ও আগস্টে।

রাজশাহী, রংপুর, খুলনা এবং বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে বেশি এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে। এ পতঙ্গের কামড়ে আক্রান্ত হচ্ছে অধিবাসীরা। অনেকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরছেন। আবার অনেকে ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে আসছেন।

সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত বাড়ছে। বর্তমানে সিটি করপোরেশন, জেলা ও ইউনিয়ন ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশা। এই পতঙ্গ নির্মূল করা সম্ভব নয়, তবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সেজন্য সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মসূচির পাশাপাশি জনগণকে সচেতন হতে হবে। কারণ. এই পতঙ্গ স্বচ্ছ-পরিষ্কার পানিতে ডিম দেয়। বাড়ির আনাচে-কানাচে কোথাও পানি জমা রাখা যাবে না। বিশেষ করে ফ্রিজের পানি, এসির পানি, ফুলের টব বা খোলা পাত্রে পানি জমতে দেওয়া যাবে না।

ডেঙ্গু পরিস্থিতির সতর্কবার্তা দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, বর্তমানে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকায় স্থিতিশীল থাকলেও ঢাকার বাইরে রোগী বাড়ছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, প্রতিদিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে। যার বেশিরভাগ রোগীর ওষুধে বমি ও মাথাব্যথা বন্ধ হচ্ছে না। অনেক রোগীর রক্তচাপ একবারেই কমে যাচ্ছে। কিডনি ও মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাসে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মশক বিশেষজ্ঞ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশে এ বছর এডিস মশা ছড়িয়ে পড়বে, এই শঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। এখন এডিস মশা ছড়িয়েও গেছে, যা সরকারি হিসাবে উঠে আসছে। কারণ, আমাদের শুধু ঢাকার দিকেই নজর থাকে। অথচ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কোনো কাজ করা হয় না। জনবল-যন্ত্রপাতির কিছুই নেই। যা দু-একজন আছে, তাদের অভিজ্ঞতা নেই। ওষুধ নেই। তাহলে তারা কীভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে জনবল-যন্ত্রপাতি-প্রশিক্ষণ-ওষুধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ডেঙ্গুতে মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

তিনি আরো বলেন, এডিস মশা দিনের বেলা যেভাবে কামড়ায়, তেমনি রাতেও কামড়ায়। তবে রাতের বেলায় কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে। ইতোমধ্যে আমরা জানতাম এডিস মশা শুধুমাত্র দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে এবং বিকেলে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি এবং মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দেখেছি এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার ১ লাখ ৩৪ হাজার ৯০৪টি মশার ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে বিকাল ৪টায় থেকে রাত ৯টার মধ্যে দেখা যায়, মশাগুলোর বিকেল ৪টায় যেমন সক্রিয়, তেমনি রাত ৯টায়ও একইভাবে সক্রিয় ছিল।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, এডিস মশার কামড়ে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে, যা চিকিৎসক থেকে শুরু পুরো দেশের মানুষের মধ্যে বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, কেউ যদি ডেন-১ দিয়ে প্রথমবার আক্রান্ত হয় এবং দ্বিতীয়বার ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত হলে ঝুঁকি বেশি হয়। বর্তমানে ডেন-২ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) ডা. ফজলে শামসুল কবির আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সিটি করপোরেশনের একারপক্ষে এডিস মশা নির্মূল করা কখনই সম্ভব নয়। সেজন্য বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে ভবনের ছাদ, বেজম্যান্ট, পলিথিনসহ বিভিন্ন স্থানের পানি পরিষ্কারে জনগণকে একযোগে মাঠে নামতে হবে। এছাড়া কখনই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে না। বিশেষ করে কয়েক বছর আগে জুন, জুলাই ও আগস্টে ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখন এডিস মশা এতোটাই বিস্তার লাভ করেছে বছরজুড়ে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ডিএসসিসির আওতাধীন এলাকায় প্রতিদিন ১ হাজার ৫০ জন মশককর্মী এবং ৭৫ জন সুপারভাইজার সকাল-বিকাল মশা নিধন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, জনবল ও মশার ওষুধ রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত