দ্বিতীয় দিনেও জলমগ্ন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরীর নিচু এলাকায় থৈ থৈ করছে পানি। গতকাল দিনভর হালকা থেকে ভারি বর্ষণে কোমর পানিতে তলিয়ে যায় বিভিন্ন এলাকা। গতকালসহ টানা তিন দিন ধরে ডুবে আছে নগরীর সড়ক ও অলিগলি। পানি প্রবেশ করেছে বাসাবাড়ি ও বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। গতকালও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ি দিনভর জলমগ্ন ছিল। নিজ বাড়িতেই তিনি ছিলেন পানিবন্দি। গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ উজ্জ্বল কান্তি নাথ বলেন, বৃষ্টিপাত আরো কয়েক দিন অব্যাহত থাকবে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। নিম্নচাপের কারণেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভারি বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে। সরেজমিন গতকাল দুপুরে দেখা গেছে, নগরীর মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমেছে সড়কে। পানিতে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বহু যানবাহন বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সড়কের দুই পাশে যানবাহনের দীর্ঘ জট সৃষ্টি হয়েছে। পানি ঢুকেছে বহদ্দারহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি ভবনের নিচতলায়। চট্টগ্রাম ওয়াসার নিচতলায়ও পানি ঢুকেছে। মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ির সামনের সড়কে কোমর সমান পানি। তার বাড়িতেও পানি ঢুকেছে। বহদ্দারহাট এলাকার প্রতিটি অলিগলিতে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমেছে।

অন্যদিকে গতকাল ও পানি ঢুকেছে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন পণ্যের গুদামে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন। নগরীর বাদুরতলা, বাকলিয়া মাস্টার পোল, কমার্স কলেজ এলাকায় বাসা-বাড়িতে পানি প্রবেশের পাশাপাশি বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে পণ্য। নগরীর বাকলিয়া মিয়াখান নগর, চকবাজার, ষোলশহর, হালিশহর, মুরাদপুর, চান্দগাঁও, বলিরহাট, ছোট পুল, বড় পুল, মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকা, সিডিএ আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ আবাসিক, রিয়াজুদ্দিন বাজার, মেহেদীবাগ, ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতায় দিনভর পানিবন্দি ছিল বাসিন্দারা।

এদিকে হাজার কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প কাজ শেষ পর্যায়ে থাকা অবস্থায় বর্ষণে তলিয়ে যাচ্ছে নগরীর বড় অংশ। এতে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে প্রকল্পের কার্যকারিতা এবং মেগা প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সুফল মিলছে প্রকল্পের। এখন খুব বেশি সময় পানি সড়ক কিংবা অলি গলিতে থাকছে না। পুরো প্রকল্প কাজ যখন শেষ হবে, তখন শতভাগ সুফল মিলবে। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত নালা নর্দমা পরিষ্কার রাখতে হবে। অন্যথায় খাল খনন কাজ শেষ হলেও পানি আটতে থাকবে। তবে নগরবাসীর প্রশ্ন মেগা প্রকল্প কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। প্রকল্প কাজে ব্যয় হয়েছে হাজার কোটি টাকা। জলাবদ্ধতা সমস্যা যদি পুরোপুরি দূর না হয় তবে এত টাকা ব্যয়ের কি প্রয়োজন ছিল। তাতে প্রকল্পের নামে শুধু কালক্ষেপণ করা হয়েছে। বাস্তবে কোনো সুফল মিলছে না।

নগরীর বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা জামাল উদ্দিন বলেন, খাল উপচে পানি অলিগলিতে প্রবেশ করছে। অথচ এই খালগুলো অনেক গভীর করে নতুন করে তৈরি করা হয়। যাতে ভারি বর্ষণের সময় পানি দ্রুত সরে যায়। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে পানি আগের মতো সরছে না। এতে জলাবদ্ধতা সমস্যা রয়েই গেল। আমার প্রশ্ন- প্রকল্প কাজে কোনো ধরনের গলদ আছে কি না; না হয় প্রকল্প কাজ শেষ পর্যায়ে থাকা অবস্থায় বন্দর নগরী এভাবে জলমগ্ন হয় কী করে। প্রকল্পকাজের সাথে যুক্ত দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ভারি বৃষ্টির সময় দেখা যায় কর্ণফুলী নদীতে জোয়ারের প্রভাব। জোয়ারের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের আওতায় তৈরি করা নগরীর খালের মুখের স্লুইচ গেটগুলো চালু করা যায়নি। নানা কারণে তা চালু করা যায়নি। এতে জোয়ারের পানি ঢুকে যায় শহরে। জোয়ারের প্রভাবে মুহূর্তেই খালগুলো পানিতে টইটম্বুর হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময় বৃষ্টির পানি দ্রুত সরতে পারেনি। এতে নিচু এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। তাছাড়া বৃষ্টির সময় উচ্চ জোয়ার থাকায় খালগুলো অস্বাভাবিকভাবে ফুলেফেঁপে উঠে পানিতে। জোয়ারের পানিতে খাল ভরে গেলে বৃষ্টির পানি গ্রহণ করতে পারে না। এ সময় বৃষ্টির পানি উপচে পড়ে নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।

এদিকে টানা বর্ষণে কর্ণফুলী নদীর পাশাপাশি শঙ্খ নদীতে নেমে এসেছে পাহাড়ি ঢল। তবে দুই নদীতেই এখনো বিপৎসীমার নিচে রয়েছে পানির প্রবাহ। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে শঙ্খ নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করার আশঙ্কা আছে। এতে নদীর তীরবর্তী দোহাজারী পৌরসভা, বৈলতলী, বরমা, বরকল, সাতবাড়িয়া, পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন কালিয়াইশ, মাইঙ্গাপাড়া, ধর্মপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিতে পারে। এরই মধ্যে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে বন্যার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গত দুই দিন উপজেলার দোহাজারী শঙ্খনদের তীরে দেখা যায়, পাহাড়ি ঢলের পানি নেমে আসায় শঙ্খনদের পানি তীব্র গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানির তীব্রতা বাড়ছে, ফলে যে কোনো মুহূর্তে পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে। এতে চন্দনাইশ-সাতকানিয়ায় বন্যা দেখা দিতে পারে। চলতি মৌসুমে বন্যা দেখা দিলে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে জানান চন্দনাইশের দোহাজারী পৌরসভা ও সাতকানিয়ার পূর্ব কাটগড় ও কালিয়াইশের বাসিন্দারা।