শোকাবহ আগস্ট

ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা

প্রকাশ : ০৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পরবর্তী সরকারগুলো এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার তো করেইনি, বরং বিচার বন্ধে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। ওই সব সরকার নানা প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করায় বঙ্গবন্ধুর বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত। একটা দেশের সরকারপ্রধানকে হত্যার বিচার করতে হলে মামলার অত্যাবশ্যকীয় তথ্য-উপাত্তের দরকার হয়। দীর্ঘদিন পর ওইসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার কাজটি ছিল বাস্তবিক অর্থে অনেক কঠিন। তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সেই কাজটি করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দের নেতৃতাধীন একটি টিম। তদন্ত টিমটি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মামলার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে চার্জশিট দেয়। ২১ বছর রাজপথের রাজনীতি করে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ সুগম হয়। ওই বছরের ১৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর দেড় মাস আগে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ির কেয়ারটেকার এবং পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন। এর পরই মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডির এএসপি আবদুল কাহার আকন্দ। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তখন মামলা কিংবা জিডি কোনোটাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। আ ফ ম মহিতুল ইসলাম যা দেখেছিলেন সেই অনুযায়ী একটি বিস্তারিত এজাহার দেন এবং তার ভিত্তিতেই তদন্ত শুরু করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে খুঁজে খুঁজে নথিপত্র বের করা হয়। ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা বিভিন্নভাবে এ হত্যাকাণ্ডের আলামত ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করেছে। সেনাবাহিনী ছাড়াও বিভিন্ন জায়গা থেকে নথিপত্র উদ্ধার করা হয়। তারপর তদন্ত শেষ করে ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ২০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। তদন্তে নাম এলেও চার্জশিটের আগে মারা যাওয়ায় সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ কয়েকজনের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ওই বছরের ১২ মার্চ কয়েকজন আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বিচার প্রক্রিয়া শুরুর পর ১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ নানা কারণে আটবার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এ মামলার বিচারক কাজী গোলাম রসুল সাবেক ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। নিম্ন আদালতে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শেষে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচারপতি এম রহুল আমিন এবং এবিএম খায়রুল হক বিভক্ত রায় দেন। বিচারপতি এম রহুল আমিন ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অন্যদিকে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ১৫ আসামিরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরে এ মামলার নথি হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চে পাঠানো হয়। সেই তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন। বাকি তিনজনকে খালাস দেন তিনি। ‘মামলাটির এ পর্যায়ে সরকারের পরিবর্তন হয়ে যায়। তখন রায় বাস্তবায়ন দেরি হলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে মামলার বাকি কার্যক্রম শেষ হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও একেএম মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যায় ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এর আগে ৬ এপ্রিল (২০২০) মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে মাজেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছে আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন ও রাশেদ চৌধুরী। তারা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। ধারণা করা হয়, অপর আসামি আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিকে কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়টি আটকে আছে সেদেশের আইনি জটিলতায়। তবে পলাতক আব্দুর রশিদ, ডালিম, মোসলেম উদ্দিনের অবস্থান এখনো জানা যায়নি। এই খুনিদের স্বজনদের মোবাইল ট্র্যাকিং করেও কোনো খোঁজ মেলেনি। যে কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিলেও বাংলাদেশে জাতির পিতার হত্যার বিচারই আটকে দেয়ার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসেই বিরল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের রক্ষায় একটি অধ্যাদেশ জারি করেন ‘স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের রক্ষার পথটি স্থায়ী করার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিল করলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ খোলে। এরপর বিচারপ্রক্রিয়া শেষে আদালতের চূড়ান্ত রায় অনুযায়ী ছয় খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। তবে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পাঁচজন এখনও রয়েছেন পলাতক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় বসে সামরিক আইন জারি করেন বঙ্গবন্ধু সরকারেরই মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক। ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দায়মুক্তি অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এমএইচ রহমান। দুই অংশের অধ্যাদেশটির প্রথম অংশে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থি যাই কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। আর দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যায়ন করবেন, তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। এই অধ্যাদেশ জারির পেছনে তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের হাত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। যিনি তার ঠিক আগেই সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয়ে জিয়া ওই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দায়মুক্তি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা পাকাপোক্তভাবে দায়মুক্তি পেয়ে যায়। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ফলে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অঘোষিত রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। এতে করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধা ছিল না। এদিকে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত চার খুনির রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আত্মস্বীকৃত এই চার খুনি হলো- লেফটেন্যান্টট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস নুর চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট রাশেদ চৌধুরী ও নায়েক সুবেদার মোসলেম উদ্দিন খান। শরিফুল হক ডালিমকে ‘বীর উত্তম’, নুর চৌধুরীকে ‘বীর বিক্রম’, রাশেদ চৌধুরীকে ‘বীরপ্রতীক’ ও মোসলেহ উদ্দিনকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দেওয়া হয়েছিল।’