বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা

বিমানবন্দরগুলোতে বার্ডহিট ‘ভীতি’

প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  উমর ফারুক আল হাদী

লেজার রশ্মির ব্যবহার, বিশেষ ডিভাইজে মনিটরিং, অ্যাম্বুলেন্সের বিশেষ শব্দ, শর্টগানের শব্দ- কোনো কিছুতেই দেশের বিমানবন্দরগুলোতে থেমে নেই পাখিদের আনাগোনা। ফলে বিমান পরিচালনা করতে গিয়ে বিমানবন্দরগুলোতে বার্ডহিটের ভীতিতে ভুগছেন পাইলটরা। উড়ন্ত পাখির সাথে উড়োজাহাজের সংঘর্ষে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন একাধিক পাইলট। তারা বলছেন, বিমানবন্দরগুলোতে পাখি তাড়ানোর জন্য যেসব পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেগুলোতে কোনো কাজ হচ্ছে না। দিন দিন বাড়ছে পাখির আনাগোনা। এরই মধ্যে গত ১০ মাসে পাখির সাথে উড়োজাহাজের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে কমপক্ষে ৩২টি। এতে প্রাণহানির ঘটনা না ঘটলেও উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বড় ধরনের বিমান দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সিভিল এভিয়েশন বলেছে, পাখির আনাগোনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। বর্তমানে বিশেষ ডিভাইজের সাহায্যে মনিটরিং করে লেজার রশ্মি ও বিশেষ সাউন্ড ব্যবহার করে পাখি তাড়ানো হচ্ছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেশের সবকটি বিমানবন্দরে পাখি তাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সেই সাথে ম্যানুয়েলিও পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থাও অব্যাহত থাকবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ আটটি বিমানবন্দর রয়েছে। এসব বিমানবন্দরে পাখি তাড়ানোর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। শুধু শাহজালাল বিমানবন্দরে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। একাধিক পাইলট জানান, বিমান অবতরণ ও উড্ডয়নের সময়ে উড়ন্ত পাখির সাথে সংঘর্ষ হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। বর্তমানে হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশে পাখিদের আনাগোনা বেড়ে গেছে।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন পাইলট অভিযোগ করে বলেন, সিভিল এভিয়েশনের অবহেলার কারণে পাখি তাড়ানোর জন্য কার্যকর ও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নেই কোনো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। উড়োজাহাজে বার্ডহিট প্রতিরোধে এবং বিমানবন্দরে পাখি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা নেই দীর্ঘদিন থেকেই। শাহজালাল বিমানবন্দরে পাখি তাড়ানোর জন্য সিভিল এভিয়েশন গত কয়েক মাস আগে অ্যাম্বুলেন্সের বিশেষ শব্দের মাধ্যমে পাখি তাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে পাখি তাড়ানোর জন্য নেই কার্যকর আধুনিক প্রযুক্তি, প্রয়োজনীয় শর্টগান বা বন্দুক ও প্রয়োজনীয় জনবল। ফলে বিমানবন্দরগুলোতে প্রতিদিন শত শত পাখি অবাধে বিচরণ করছে। বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় পাইলটরা থাকেন আতঙ্কে। নিরাপদে বিমান অবতরণ ও উড্ডয়ন করতে গিয়ে উড়ন্ত পাখি এড়িয়ে চলতে পাইলটদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

একাধিক পাইলটের অভিযোগ, সিভিল এভিয়েশন বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে এ সমস্যা নিরসনের কোনো পদক্ষেপ নেই। এরই মধ্যে বার্ডহিটে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে কয়েকটি উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু গত ১০ মাসেই শাহজালাল, ওসমানী ও শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন উড়োজাহাজের সাথে উড়ন্ত পাখির সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ৩২টি। এসব ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটলেও কয়েকটি বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাইলটদের বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতার কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলেও ভীতি কাটেনি।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন পাইলট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিভিল এভিয়েশনের বড় বড় প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। অথচ বার্ডহিট প্রতিরোধে সিভিল এভিয়েশনের কোনো প্রকল্পও নেই। নেই কোনো গবেষণা ও পাখি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের উদ্যোগ।

পাইলটরা বলেছেন, উড়ন্ত পাখি যদি উড়োজাহাজের ডানায় থাকা ইঞ্জিনের ভেতরে ঢুকে যায়, তখন ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। উড়োজাহাজের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাইলট যদি পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারেন, তাহলে বড় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে আটটি বিমানবন্দর রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। হযরত শাহজালাল, শাহ আমানত ও সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ সব কয়টি বিমানবন্দরে উড়ন্ত পাখিদের আনাগোনা রয়েছে। বিমানবন্দরগুলোর পাশেই রয়েছে প্রচুর ঝোঁপ-জঙ্গল, গাছপালা ও জলাশয়। এগুলোতে রয়েছে পাখিদের প্রচুর খাবার। পোকা-মাকড়সহ বিভিন্ন ধরনের খাবার খেতে পাখিরা সার্বক্ষণিক ভিড় করে। তবে বিকালে ও সকালে পাখিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। শীতকালে এসব পাখির ভিড় ও উড়ন্ত পাখির যাতায়াত আরো অধিক হারে বেড়ে যায়। এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, বার্ডহিটের কারণে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বলাকা ভবন সূত্র জানায়, গত ২৬ ডিসেম্বর বিমানের অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণের সময় ইঞ্জিনে পাখির আঘাত লাগে। পাইলটের দক্ষতায় যদিও বিমানটি ৮৭ জন যাত্রী নিয়ে নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। তবে ওই উড়োজাহাজটি ক্ষতির কারণে গ্রাউন্ডেড করতে হয়। এর আগে গত বছর ১৪ আগস্ট সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ওই বিমানটি অবতরণের সময় পাখির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এভাবে শাহ আমানত, রাজশাহী ও কক্সবাজারে প্রায়ই উড়ন্ত পাখির সাথে বিমানের সংঘর্ষ হয়।

বিমান ও ইউএস বাংলার একাধিক পাইলট জানান, বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে এখন দেশের বিমানবন্দরগুলোতে বড় ভীতি হচ্ছে উড়ন্ত পাখির আঘাত বা বার্ডহিট। বিমান যখন আকাশে উড়ে, তখন বিপরীত দিক থেকে পাখি এসে আঘাত করলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। উড়ন্ত পাখিদের মধ্যে শুধু ছোট ছোট পাখি নয়, মাঝেমধ্যে বাজপাখি, ঈগল, শকুন, কবুতর, অতিথি রাজহংস ইত্যাদিও দেখা যায়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সবকয়টি বিমানবন্দরে শুধু পাখিই নয়, বেজি, শেয়াল, বক ও বাদুড়ের উৎপাত বেড়েছে। বিমানবন্দরের পাশের জঙ্গল ও গাছপালাতে প্রতিদিন শত শত পাখি দেখা যায়।

জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাখি তাড়ানোর জন্য আটজন শুটার থাকলেও মাত্র দুইটি বন্দুক সচল রয়েছে। বাকি চারটি বন্দুক অকেজো হয়ে পড়ে আছে। আবার মাঝেমধ্যে ওই সচল দুইটির একটি নষ্ট থাকে।

জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, পাখি তাড়ানোর জন্য আমরা শাহজালাল বিমানবন্দরে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছি। খুব দ্রুত তা অন্যান্য বন্দরেও কার্যকর করা হবে। চেয়ারম্যান বলেন, আমরা শর্টগান ও বন্দুক কেনারও পদক্ষেপ নিয়েছি। সেই সাথে পাখি তাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পাখি নিয়ন্ত্রণের জন্য রাডারসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এক ধরনের রাডার আছে, যা অ্যাকুস্টিক সাউন্ড দেবে এবং ওই রাডার দিয়ে স্ক্যান করবে এবং লেজার রশ্মি দিয়ে পাখি তাড়ানো হবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে শাহজালাল বিমানবন্দরে আধুনিক ডিভাইজ ব্যবহার করে পাখি তাড়ানো হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য বিমানবন্দরেও এ পদ্ধতি চালু করা হবে। এজন্য আমরা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও আধুনিক প্রযুক্তির মনিটরিং ডিভাইজ স্থাপনের পদক্ষেপ নিয়েছি।

বিমানবন্দরে কর্মরত একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, সিভিল এভিয়েশন পাখি তাড়ানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে- এমনটি দৃশ্যমান নয়। বিমানবন্দরের রানওয়েতে অবাধে পাখির আনাগোনা দেখা যায়। বিমানবন্দরের চারপাশেই আছে চলাশয়, জঙ্গল, ঝোঁপঝাড়। এগুলোতে সবসময় শত শত পাখি দেখা যায়। খাবার খেতে পাখিরা বিমানবন্দরের রানওয়েতে আসে, জলাশয় ও জঙ্গলের গাছপালাতে যাতায়াত করে। উড়ন্ত পাখি দেখলেই পাইলটরা আতঙ্কে থাকেন।

বিমান উড্ডয়ন-অবতরণের সময় বার্ডহিটের আতঙ্কে পাইলটরা শঙ্কিত থাকেন। কিছুদিন লেজার লাইট ব্যবহার করে এবং আল্ট্রা সাউন্ডের মাধ্যমে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে তাও কাজ হচ্ছে না।

বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বার্ডহিট আতঙ্কে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলো শাহজালাল, শাহ আমানত এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। তারপরে রয়েছে কক্সবাজার, যশোর, রাজশাহী, বরিশাল ও সৈয়দপুর। এসব বিমানবন্দরে পাশের গাছপালাতে রয়েছে পাখিদের অবাধ বিচরণ।

সরেজমিন দেখা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রানওয়ের চারপাশে দলিপাড়া, বাউনিয়া এলাকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি জলাশয়। এসব জলাশয়ে মাছ, কীটপতঙ্গ ও জলজ উদ্ভিদ পাখিদের আকর্ষণীয় খাবার। এসব স্থানে খাবার খেতে বিভিন্ন জাতের পাখি যাতায়াত করে। বক, ঈগল, শকুন, বাদুড় ছাড়া আরো নানান জাতের ছোট-বড় পাখির অবাধ বিচরণ রয়েছে।

বাংলাদেশ বিমান প্রশিক্ষণ একাডেমির একজন পাইলট জানান, সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের চারপাশে প্রচুর গাছপালা রয়েছে। এছাড়া রানওয়ের পাশেই খালি জায়গাতে বাজপাখি, বকসহ বিভিন্ন ধরনের পাখি দেখা যায় সব সময়।

এছাড়া রাজশাহী বিমানবন্দরের রানওয়ের একপাশে ৪০-৫০টি বাজপাখি বসে থাকে। অন্যপাশে একটি লেক রয়েছে। সেখানে মাছ ধরতে মাছরাঙ্গা পাখি, বক পাখি এবং মাঝেমধ্যে চিল ও ঈগল পাখি নেমে আসে। এগুলো বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য খুবই বিপজ্জনক।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন ড. কামরুল ইসলাম বলেন, আগের চেয়ে এখন বার্ডহিট কমেছে। পাখির উপদ্রব কমেছে। কারণ পাখিদের আনাগোনাও কমেছে। পাখি তাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, শীতকালে পাখি বেশি দেখা গেলেও এখন অনেক কম। এছাড়া পাখি তাড়ানোর জন্য শুটারসহ প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি ও পাখি তাড়ানোর অস্ত্র কেনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পরিচালক কামরুল ইসলাম আরো বলেন, বার্ডহিটের আশঙ্কা আগের মতো আর নেই। এখন বন্দুক দিয়ে শুটাররা ফাঁকা গুলি করে পাখি তাড়ানোর পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্সের শব্দের মাধ্যমেও পাখি তাড়ানো হচ্ছে। আছে আধুনিক মনিটরিং ডিভাইজ ও লেজার রশ্মির ব্যবহার। তিনি বলেন, শাহজালাল বিমানবন্দরে পাখি তাড়ানোর একাধিক পদ্ধতি অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তীতে অন্যান্য বিমানবন্দরেও এসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। এদিকে পাইলটরা বলেছেন, আকাশের ১০ হাজার ফুট ওপর দিয়ে পাখি চলাচল বেশি থাকে। ফলে ওই স্তরে ঝুঁকিও বেশি। এছাড়া উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় যদি কোনো পাখির সাথে সংঘর্ষ হয়, তবে পাখির গতি দ্বিগুণ বেড়ে গিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে আঘাত করে। ইঞ্জিনে ঢুকে গেলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা থাকে।