মাদকের আড্ডা ও বখাটেদের উৎপাত বন্ধ

রমনা পার্কের শতাধিক অবৈধ বাড়ি অপসারণ

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রমনা পার্কের ভেতরে মাদকের আড্ডা, ছিনতাইকারী, বখাটেদের উৎপাত ও নারী উত্ত্যক্তকরণ বন্ধে শতাধিক অবৈধ বাড়ি ভেঙে দিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। এতে ৬৮ দশমিক ৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা পার্কের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়েছে। জানা গেছে, পার্কে বৈধ বাড়ি ছিল ১৯টি আর অবৈধ দেড়শতাধিক। বছরের পর বছর বাড়িগুলো থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ভাড়া তুলে ভাগবাঁটোয়ারা করা হতো। এছাড়া মাদকের নিরাপদ রুট হিসেবে রমনা পার্ককে ব্যবহার করা হয়েছে। এজন্য বাড়িগুলো ভেঙে দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের কঠোর পদক্ষেপের ফলে এসব বাড়ি ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এখন বর্ধিত অংশের উন্নয়নের কাজ এগিয়ে চলছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকা ক্লাবের সীমনা ঘেঁষে রমনা পার্কের ভেতরে নির্মাণ করা শতাধিক অবৈধ বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভাঙা বাড়ির পুরোনো ইট সরানোর ব্যবস্থা এবং ভূমি উন্নয়নের কাজ জোরেসোরে করছেন শ্রমিকরা। উদ্ধার করা জায়গায় নতুনরূপে সাজানোর কাজ বাস্তবায়নে তদারকি করছেন গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

সূত্র জানায়, পার্কে থাকা বাড়ি ভাঙতে কয়েক বছর ধরে বসবাসকারীদের সঙ্গে আলোচনা হয়। তাদের ঘর সরিয়ে নিতে বলা হলেও তারা শোনেনি। এতে পার্কের সংস্কারকাজ শেষ করা যায়নি। এবার বাধ্য হয়ে, অবৈধ বাড়ি ভেঙে দিয়ে এবং গণপূর্তের কর্মচারীদের অন্যত্রে বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পার্কটির উন্নয়ন কাজে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা বলছেন, রমনা পার্কটিতে যেন সবাই হাঁটাহাঁটি করতে পারেন, সেই কারণে চারিদিক উন্মুক্ত রেখে উদ্ধারকৃত জায়গায় আমরা কাজ করছি। পার্কের এই অংশের উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ শেষ হলে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবেন কর্তৃপক্ষ। রাজধানীতে যে কয়েকটি পার্ক রয়েছে এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রমনা পার্ক। সন্ধ্যা নামলেই ঐতিহাসিক পার্কটিতে মাদকসেবীদের আড্ডা বেড়ে যায়। গভীর রাতে পার্কের দেয়াল ঘেঁষে ভাসমান যৌন কর্মীদের প্রকাশ্যেই চলতো দেহ ব্যবসা। সেই সঙ্গে চুরি, ছিনতাইকারীদের উৎপাত। ফলে পার্কে আগত দর্শনার্থী ও পথচারীদের সন্ধ্যার পর ভয়ে চলাচল করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারুল আক্তার প্রায়ই সহপাঠীদের নিয়ে পার্কে ঘুরতে আসেন। তার মতে, পার্কের ভেতরে বাড়ি থাকায় যথেষ্ট নিরাপত্তার অভাব ছিল। তা না হলে পার্কের আনাচেকানাচে মাদকসেবন করে কীভাবে? এসব পরিস্থিতি যখন চোখে পড়ে তখন সাধারণ লোকজনের মনে ভয় তো সৃষ্টি হয়ই। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এখানে ঘুরতে আসে, তাদেরও এসব কারণে খারাপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। বিনোদনের স্থানগুলো হবে বিনোদনের মতোই। যেখানে লোকজন প্রাণ খুলে বসবে, আড্ডা দেবে, গল্প করবে। এখানে উল্টোটা ছিল। সন্ধ্যা নামলেই পার্কের ভেতরে ভয়ে ভয়ে চলাচল করতে হয়েছিল।

রমনা পার্কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কয়েকজন আনসার সদস্য বলেন, রমনায় যারা ঘুরতে আসেন, তাদের অধিকাংশই দর্শনার্থী শিক্ষার্থী কিংবা চাকরিজীবী। বাইরে থেকেও অনেকে আসেন। তবে এসব দর্শনার্থীর মালামাল চুরি, ছিনতাই ও প্রতারণ করে অপরাধীরা অবৈধ বাড়িগুলোর বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে পড়ত। নানা সময় অপরাধমূলক কাজ হয়েছে। আনসার সদস্যরা নিয়মিত টহলে থাকলেও মাদকসেবী ও ছিনতাই ঠেকানো কঠিন ছিল। বর্তমানে বাড়িগুলো অপসারণ করায় মাদকসেবন ও ছিনতাই বন্ধ হয়েছে।

গণপূর্তের সংশ্লিষ্টরা বলেন, রমনা পার্কের ভেতরে বাড়ি নির্মাণ করায় পরিবেশ নষ্ট হতে থাকে। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা পার্কের ভেতর দিয়ে মানুষ চলাচল করত। বাড়িগুলো কেন্দ্র করে মাদকের আড্ডা, বখাটেদের উৎপাত, পার্কের ভেতরে অনৈতিক কার্যকলাপ এবং সীমানা ঘেঁষে অবৈধ কাঠামো নির্মাণসহ নানা অভিযোগ ওঠে। এরপরও বাড়িগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি। তবে বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের নির্দেশে বাড়িগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন পার্কের বর্ধিত অংশে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।

নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মণ্ডল আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, পার্কে আসা দর্শনার্থীদের অবাধ যাতায়াত ও সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অবৈধ বাড়িগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। শতাধিক বাড়ির মধ্যে ১৯টি বৈধ ছিল, তাদের অন্যত্রে স্থানান্তর করা হয়েছে। বাড়িগুলো ভেঙে দেওয়া পার্কের আয়তন বেড়েছে। এই অংশের কাজ শেষ হলে পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা আরো মুগ্ধ হবেন।

রমনা পার্ক সেজেছে নতুন রূপে: অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনে রমনা পার্ক সেজেছে নতুন রূপে। তীব্র রোদেও সাজানো গোছানো এই পার্কের ভেতরে হাঁটার রাস্তাগুলো থাকে ছায়ায় ঘেরা। হাঁটতে হাঁটতে আবার শোনা যায় পাখির ডাক, পাশ দিয়েই ভোঁ দৌড় দেয় কাঠবিড়ালী। ভেতরের হাঁটার রাস্তায় আধুনিক লাইটিংয়ের ব্যবস্থা সন্ধ্যায় আনে ভিন্ন এক রূপ। লেকের দুই পাশে কাঠ দিয়ে যে সেতু করা হয়েছে, সেটিও দৃষ্টিনন্দন। এছাড়াও পার্কটিতে শিশুদের খেলার যে জায়গা তৈরি হয়েছে, তাতে আছে দারুণ সব রাইড। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কের ভেতরে শিশুদের মেলা। বাবা-মাকে নিয়ে শিশুরা বারবার আসেন রমনা পার্কে।

রমনা পার্ক কেবল সময় কাটানো নয়, শরীর চর্চা আর হাঁটাহাঁটির জন্যও পরিবেশটি দারুণ। ব্যায়াম করার জন্য কিছু স্থায়ী স্থাপনা আছে। ব্যায়াম করার পর আছে বিশ্রামের জায়গা। আধুনিক টয়লেট সুবিধাও গড়ে তোলা হয়েছে পার্কে, যেটি ঢাকার পার্কে বিরলই বলা যায়। চায়নিজ রেস্তোরাঁ ভেঙে নির্মাণ হয়েছে কফি কর্নার।

প্রাণের উচ্ছ্বাস: ৬৮ দশমিক ৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা এ পার্কে রয়েছে প্রায় ২১১ প্রজাতির উদ্ভিদ। যার মধ্যে আছে নাগলিঙ্গম, অশোক, রক্তকাঞ্চনসহ দুর্লভ প্রজাতির ছোট বড় গাছ। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের নির্দেশনায় নাম না জানা সকল বৃক্ষের নামফলক লাগানোর সুবাদে কৌতুহলি দর্শকদের জানার চাহিদা পূরণ হয়েছে। একই সঙ্গে বৃক্ষপ্রেমিক ও উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের একটি জীবন্ত শিক্ষালয় হিসেবে এ পার্কের কদর বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণে।

গণপূর্ত অধিদপ্তর প্রায় ৪৬ কোটি টাকা খরচ করে পার্কটিকে ঢেলে সাজায়। এর অংশ হিসেবে পার্কের ভেতরে লেক খনন করে তৈরি হয়েছে দুই লেনের কাঠের ডেক। হাঁটার জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়েছে লাল সিরামিক ইট দিয়ে। আছে বিটুমিনাস কার্পেটের রাস্তাও। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়েছে শিশু চত্বরটি।

রমনা পার্কে প্রায়ই ঘুরতে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শরীফুল ইসলাম সাগর। তিনি বলেন, যান্ত্রিক শহরে একটু স্বস্তির আসায় পার্কে এসেছি। এখানে এলে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। এখানে বিরল গাছপালা আছে, যা শহরের অন্য কোথাও সহজে পাওয়া যায় না। কর্মব্যস্ত জীবনে হাঁপিয়ে উঠলে এখানে এলেই ক্লান্তি দূরের প্রণোদনা পাওয়া যায়। শরীফুল ইসলাম আরো বলেন, রমনা পার্কে হাঁটাহাঁরি করার পাশাপাশি ব্যায়াম করার সুযোগ আছে, যেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও খুব ভালো। এখানে চুরি-ছিনতাই হয় না। সব কিছু মিলিয়ে পরিবেশটা খুবই মনোরম। সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সিরাজুল হোসেন সহকর্মীদের নিয়ে পার্কে বেড়াতে আসেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও রমনা পার্ক অনেক জরাজীর্ণ ছিল। পরিবেশ এতোটা ভালো ছিল না। এখন ঘুরতে খুবই ভালো লাগছে। লেকের পাশে সুন্দর ব্রিজ হয়েছে, এখানে হাঁটলে অনেক ভালো লাগে। শরীরের ক্লান্তি দূর হয়। সপরিবারে লালবাগ থেকে আসা শিউলি বেগম বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ভালো। অন্যান্য পার্কগুলোতে নেশাখোর, ভবঘুরে লোকজন বেশি দেখা যায়। তবে এই পার্কটিতে এগুলো নেই। শিশু কর্নার থাকায় সন্তানদের নিয়ে নিয়মিত পার্কে আসেন সামিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, প্রতিটি রাইড বেশ সুন্দর। এখানে এলে বাচ্চারা শেয়ার করতে শেখে, অপেক্ষা করতে শেখে। একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়। তাদের সামাজিকীকরণ ভালো হয়েছে। বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য খুব ভালো একটা পরিবেশ হয়েছে। এটা একটা উন্মুক্ত পার্ক, যখন ইচ্ছা আসা যায়। টিকিটের কোনো ঝামেলা নেই। শান্তিবাগ থেকে প্রতিদিন সকালে আসেন জাহিদ আহম্মেদ। তিনি বলেন, আমরা অনেকে ডায়াবেটিসের রোগী। সকাল-বিকাল হাঁটতে হয়। ঢাকা শহরের ধুলাবালির রাস্তায় হাঁটা যায় না। এই পার্ক হাঁটার জন্য বেশ উপযোগী। অবৈধ বাড়িগুলি অপসারণের ব্যাপারে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ’ঢাকার বাসিন্দাদের নির্মল নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রাণকেন্দ্র রমনা পার্ক। আর সেই পার্কের ভেতরে অবৈধ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব বাড়ির কারণে চব্বিশ ঘণ্টা পার্কের ভেতরে মানুষ চলাচল করতো; একইসঙ্গে পার্কের আয়তনও কমে যায়। তাই দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাড়িগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জাতির পিতার স্মৃতি সমৃদ্ধ রমনা পার্ককে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রমনা পার্ক যেমন দেখতে চেয়েছিলেন তেমনটি করা হয়েছে।’ পার্কের ভেতরে বাড়ি থাকায় দর্শনার্থীরা বিরক্ত ছিল এমন মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘পার্কে ১৯জনের নামে বৈধ বরাদ্দ ছিল। ওই কয়টি বাড়ি কে কেন্দ্র করে দেড়শতাধিক অবৈধ বাড়ি নির্মাণ করা হয়। ওখানে মাসের পর মাস বাড়ি ভাড়া তুলে একটি সিন্ডিকেট ভাগবাঁটোয়ারা করেছে। এছাড়াও মাদক চোরাচালানের নিরাপদ রুট হিসেবে রমনা পার্ক ব্যবহার করা হয়েছে। ওইসব অনৈতিক কর্মের সঙ্গে কিছু আনসার সদস্য জড়িত থাকার কথা শোনা যায়।’

গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রমনা পার্কে লেকের দুই পাড়ে ডেক তৈরি করে কাঠের পাটাতনে হাঁটার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো পার্কটাই পরিষ্কার ঝকঝক করছে। কিন্তু পার্কের ভেতর কয়েকটি বৈধ বাড়ির পাশাপাশি বহু অবৈধ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব বাড়ি কেন্দ্র করে মাদকের আড্ডা ও বখাটেদের রাজত্ব গড়ে ওঠে। পরে বাধ্য হয়ে, বাড়িগুলো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এতে পুরো রমনা পার্কের সৌন্দর্য বাড়বে। তিনি আরো বলেন, পার্কে যেসব বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়েছে সেখানে নার্সারি উন্নত করা হবে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ফুলের চারা উৎপাদন করা হবে। এ ফুলের চারা পার্কজুড়ে লাগানো হবে।