শোকাবহ আগস্ট

ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বঙ্গবন্ধুর অবদান

প্রকাশ : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামের মৌলিক শিক্ষা অনুশীলনের মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধকে সারা জীবন লালন করে এর প্রচার ও প্রসারে অনবদ্য অবদান রেখেছেন। ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সংক্ষিপ্ত ক্ষমতার সময়ে ইসলামের সম্প্রসারণ এবং ইসলামী মূল্যবোধ প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, তা সমকালীন মুসলিম বিশ্বে বিরল। তিনি ইসলামের মূল্যবোধ জাগ্রত করতে জাতীয় জীবনে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলোর ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন।

বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা : বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায় আসার পর একদিকে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে হাত দিলেন, অন্য দিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ধর্মব্যবসায়ীদের তৎপরতা চিরতরে বন্ধের লক্ষ্যে শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে হাক্কানি আলিমদের সম্পৃক্ত করার জন্য একটি অধ্যাদেশের মাধমে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ গঠন করেন, যার কর্মকাল্ড আজ সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃত। শুধু তাই নয় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইসলামিক প্রকাশনা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পাচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ বলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট-এ এই প্রতিষ্ঠানের যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়, তা হচ্ছে- মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমি ও ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা ও রক্ষাণাবেক্ষণ করা; মসজিদ ও ইসলামি কেন্দ্র, একাডেমি ও ইনস্টিটিউট এবং সমাজসেবায় নিবেদিত সংগঠনসমূহকে আর্থিক সহায়তা দেয়া; সংস্কৃতি, চিন্তা, বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে ইসলামের অবদানের ওপর গবেষণা পরিচালনা; ইসলামের মৌলিক আদর্শ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, ন্যায় বিচার প্রভৃতি প্রচার করা ও প্রচারের কাজে সহায়তা করা এবং সাংস্কৃতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করা; ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতিমালা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আয় ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণার আয়োজন করা ও তা প্রসার ঘটানো ; জনপ্রিয় ইসলামি সাহিত্য সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলির সুলভ প্রকাশনা ও বিলি-বণ্টনকে উৎসাহিত করা; ইসলাম ও ইসলামের বিষয় সম্পর্কিত বই-পুস্তক, সাময়িকী ও প্রচার পুস্তিকা অনুবাদ করা, সংকলন করা ও প্রকাশ করা; ইসলামের ইতিহাস ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আয় ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদির ওপর সম্মেলন, বক্তৃতামালা, বিতর্ক ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা; ইসলামবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কার ও পদক প্রবর্তন করা; ইসলাম সম্পর্কিত প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া, প্রকল্প গ্রহণ করা কিংবা তাতে সহায়তা করা; ইসলামবিষয়ক গবেষণার জন্য বৃত্তি প্রদান করা এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদের উন্নয়ন সাধন করা। বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন এখন সরকারি অর্থে পরিচালিত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম একটি বৃহৎ সংস্থা হিসেবে নন্দিত।

বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন : মাদ্রাসা শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শেখ মুজিব মাদ্রাসা বোর্ড গঠন করে মাদ্রাসা শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তাসহ যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করেন। ইসলামি আকিদাভিত্তিক জীবন গঠন ও ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন করেন। পূর্বে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে স্বায়ত্তশাসন প্রদার করে এর নাম রাখেন ‘মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’।

বেতার ও টিভিতে কোরআন তিলাওয়াত প্রচার : বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বেতার ও টিভিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদার সাথে কোরআন তিলাওয়াত ও তাফসির প্রচার শুরু হয়। ফলে, বেতার ও টিভির অনুষ্ঠান সকালের শুভ সূচনা ও দিবসের কর্মসূচি কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাপ্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত এ ব্যবস্থাই বাংলাদেশে চালু রয়েছে।

কাকরাইল মসজিদের জন্য অতিরিক্ত জায়গা বরাদ্দ : বর্তমানে কাকরাইলের যে মসজিদে কেন্দ্রীয়ভাবে তাবলীগ জামাতের মারকাজ অনুষ্ঠিত হয়, এ মসজিদটি ছিল খুবই অপ্রশস্ত। বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের তাবলীগ জামাতের মারকাজ মসজিদের জন্য স্থান বরাদ্দ করেন এবং মসজিদটি তারই নির্দেশে সম্প্রসারিত হয়। তাবলীগ জামাতের দাওয়াতি কার্যক্রমকে ব্যাপকভিত্তিক করার জন্যই বঙ্গবন্ধু কাকরাইলের মসজিদ ও তৎসংলগ্ন জায়গা তাবলীগি মারকাসকে প্রদান করেন এবং এর মাধ্যমে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার জন্য স্থান নির্ধারণ : তাবলীগ জামাত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। ইসলামের পথে দাওয়াত দেয়াই হচ্ছে এ সংগঠনের একমাত্র কাজ। এই সংগঠনটি যাতে বাংলাদেশে অবাধে ইসলামের দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, এ উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু তাবলীগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সুবিশাল জায়গা বরাদ্দ করেন। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে দাওয়াতি কাজে সংশ্লিষ্ট হাজার হাজার তাবলীগি ভাই এ জামাতে সমবেত হন। বঙ্গবন্ধু টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমার এই স্থানটি বরাদ্দ করেছিলেন বলেই ইজতেমায় আগত লাখ লাখ মুসলিম এখানে সমবেত হয়ে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে দাওয়াতি কাজ পরিচালনার জন্য বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

হজযাত্রীদের জন্য ভ্রমণ কর রহিতকরণ : পাকিস্তান আমলে হজযাত্রীদের জন্য কোনো সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা ছিল না। বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে প্রথম হজযাত্রীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদানের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি হজযাত্রীদের ভ্রমণ কর রহিত করেন।

বাংলাদেশ সিরাত মজলিস প্রতিষ্ঠা ও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন : স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম হাক্কানী আলেম-ওলামাদের সংগঠিত করে পবিত্র ইসলামের সঠিক রূপ জনগণের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তার দিকনির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় সিরাত মজলিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। সিরাত মজলিস ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে রবিউল আউয়াল মাসে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৃহত্তর আঙ্গিকে ঈদে-মিলাদুন্নবী (স) মাহফিল উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সরকারপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু বায়তুল মোকাররম সজিদ চত্বরে মাহফিলের উদ্বোধন করেন। একজন সরকারপ্রধান হিসেবে জাতীয়ভাবে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিলের উদ্বোধন উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনে প্রতি বছর জাতীয়ভাবে ঈদে-মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল উদযাপন হয়ে আসছে।

ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শবেকদর, শবেবরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা : ইসলামের ধর্মীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুই প্রথম বাংলাদেশে ঈদে-মিলাদুন্নবী (স), শবেকদর, শবেবরাত উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। উল্লিখিত দিনসমূহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সিনেমা হলে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন তিনি।

সুশীল সমাজ গঠনে মদ ও জুয়া নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান : ইসলামে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামের নামে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে অবাধে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুই প্রথম আইন করে মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে শাস্তির বিধান জারি করেন।

রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা : রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল একটি কমিউনিস্ট দেশ। সেদেশে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাশিয়া সহযোগিতা করায় বঙ্গবন্ধুর সাথে সেদেশের নেতৃবৃন্দের একটি সুদৃঢ় বন্ধুত্বের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার পর প্রথম রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নে তাবলীগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে পূর্বের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে তাবলীগ জামাতের যেসব দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।