প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। বঙ্গবন্ধুর নেপথ্যের সহচর হিসেবে বঙ্গমাতার সংগ্রামী জীবন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারবে।
গতকাল সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ‘৯৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন এবং বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২৩’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাবা রাজনীতি করেছেন, ‘মা’ সংসারসহ সব গুছিয়ে রেখেছেন। ছোটবেলা থেকে তিনি একটা মানবিক চরিত্র নিয়ে এবং দৃঢ়চেতা মনোবল নিয়ে গড়ে উঠেছেন। বাবার রাজনৈতিক কারণে জীবনের যে চড়াই উৎরাই, মাকে কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি। বাবার পাশে থেকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। জাতির পিতা রাজনৈতিক কারণে প্রায়ই কারাগারে বন্দি থাকতেন। সেই দুঃসময়ে বঙ্গমাতা হিমালয়ের মতো অবিচল থেকে একদিকে স্বামীর কারামুক্তিসহ আওয়ামী লীগ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। অন্যদিকে, সংসার, সন্তানদের লালন-পালন, শিক্ষাদান, বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণা, শক্তি ও সাহস জুগিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে সঠিক লক্ষ্যে নিয়ে যেতে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৪৮-এ ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হবার পর ২৩ বছরের স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন করতে গিয়ে জাতির পিতা বহুবার কারাবরণ করেছেন। যে বয়সে বাবার হাত ধরে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, আমাদের সে সুযোগ হয়নি। একের পর এক মিথ্যা মামলা। সেসব নিয়ে উকিলের কাছে দৌড়ানো। সবকিছুই মা করতেন। উপরন্তু জেলে যখন বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন তখন বলতেন, ‘ঘর-সংসার নিয়ে তোমার (বঙ্গবন্ধু) চিন্তা করতে হবে না, আমি দেখব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এটাই ছিল জাতির পিতার মূল লক্ষ্য। এটা পৃথিবীর কেউ না জানলেও ‘মা’ জানতেন। কারণ, বঙ্গমাতাকে জাতির পিতা সবকিছুই বলতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে বেগম মুজিবের দৃঢ়চেতা অবস্থান বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং তিনি এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জাতির পিতাকে আগেই সতর্ক করেছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, অন্য সাধারণ নারীদের মতো ‘মা’ যদি বলত, আজকে গয়না দাও, কালকে ফার্নিচার দাও, এটা ওটা দাও তাহলে জাতির পিতা দেশটাই হয়তো স্বাধীন করতে পারতেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে এবং নির্যাতিতা নারীদের পুনর্বাসনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। সরকারপ্রধান বলেন, জাতির পিতা কারাগারে থাকার সময় ৬ দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বঙ্গমাতা বলেছিলেন ‘৬-দফার একটি দাড়ি, কমা, সেমিকোলনও বদলাবে না।’ জাতির পিতার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, যেটি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামাণ্য দলিলে ঠাঁই করে নিয়েছে সেই ভাষণ প্রদানের আগেও মায়ের পরামর্শ- ‘তোমার মনে যেটা আসবে, সেটাই বলবে। কারণ, তুমি এ দেশের মানুষকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছ,’ তার পরামর্শই নিয়েছিলেন জাতির পিতা।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দি থেকে এবং পাকিস্তানে কারাবন্দি স্বামীর জীবন নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা সত্ত্বেও বঙ্গমাতা সীমাহীন ধৈর্য, সাহস ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় আবেগাপ্লুত কণ্ঠে স্মরণ করেন, মরণেও জাতির পিতার সঙ্গ ছাড়েননি বঙ্গমাতা। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শত্রুরা আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করল, বাবাকে মেরে ফেলল। মা বের হয়ে এলেন। তারা বললেন, আপনি আমাদের সঙ্গে চলেন। মা বললেন, তোমরা যেহেতু তাকে মেরে ফেলেছ। আমাকেও গুলি করে মেরে ফেল। আমি কোথাও যাব না। জীবনের পাশাপাশি মরণেও আমার বাবার সঙ্গী হয়ে চলে গেছেন মা।
শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গমাতা পাশে থাকাতেই জাতির পিতার সাফল্য সহজ হয়েছে। শুধু ছাত্রজীবন নয়, রাজনৈতিক জীবনেও তিনি সব সময় তার বাবার ছায়াসঙ্গী হিসেবে ছিলেন। আমার বাবার সাফল্য যদি আপনারা দেখেন, সেই ছাত্রজীবন থেকে ‘মা’ পাশে থাকাতে তার জীবন কিন্তু সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। বঙ্গমাতা শুধু নিজের সংসারই চালাতেন না, হাতে যা টাকা-পয়সা আসত তাও বাবার রাজনীতির জন্য তাকে দিয়ে দিতেন। জাতির পিতার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী এ কথা জানান, ‘আব্বা-আম্মা ছাড়াও সবসময় রেণু (বঙ্গমাতা) আমাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়েছে। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলেই আমাকে দিত, কোনো দিন আপত্তি করেনি। নিজে মোটেই খরচ করত না, গ্রামের বাড়িতে থাকত। আমার জন্য সব রাখত। এভাবে তিনি আমার বাবার পাশে থেকে তাকে সবরকমের সহযোগিতা দিয়েছেন। মা সব সময় ঘর-সংসার সামাল দিতেন এবং কখনো হতাশ হননি। নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চারজন বিশিষ্ট নারী ও জাতীয় নারী ফুটবল দলের মধ্যে ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব পদক-২০২৩’ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আটটি ক্ষেত্রে নারীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতি বছর সর্বোচ্চ পাঁচজন নারীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এর আগে, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এবং গবেষণায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় নারী ফুটবল দল এবং চারজন বিশিষ্ট নারীকে এই বছরের পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করে। খেলাধুলার ক্ষেত্রে সাফ ফুটবল-২০২২ এ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন জাতীয় নারী ফুটবল দল ছাড়াও আরো চারজন নারী এই পদক লাভ করেন।