শোকাবহ আগস্ট

মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের দূরদর্শী পদক্ষেপ

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

মুজিবনগর সরকার হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী ও সূদূর প্রসারি সাংবিধানিক পদক্ষেপ ছিল মুজিবনগর সরকার গঠন। এই সরকার ছিল সম্পূর্ণ সাংবিধানিক, প্রতিনিধিত্বশীল ও বৈধ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। প্রবাসী, বিপ্লবী, অস্থায়ী বা মুজিবনগর সরকার যে নামেই ডাকা হোক না কেন; মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার মুজিবনগর সরকার নামে সর্বাধিক পরিচিত। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত কার্যকর ছিল মুজিবনগর সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, অন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এখনও বাংলাদেশের এগিয়ে চলায় নিরন্তন প্রেরণা জোগায় মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধু তার অসাধারণ নেতৃত্ব, বাঙালির প্রতি অতল ভালোবাসা, অসীম সাহসিকতা, বিরল ত্যাগ আর সৃজনশীলতা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে আপাদমস্তক বিকশিত করার পাশাপাশি ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে মহাজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি একাট্টা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৫৫ বছরের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতিসত্তা, স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। মুজিবনগর সরকার গঠিত না হলে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী অথবা বিদ্রোহী হয়ে পড়তাম। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ ছিল একটি বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী সাংবিধানিক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের মাটিতেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকার কাজ করছে, তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য শপথগ্রহণের প্রয়োজন ছিল। শপথগ্রহণের স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হলো পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননকে। এলাকাটির তিন দিকেই ভারত। তাই পাকিস্তানি বিমান হামলার শঙ্কা ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে আরেকটি ঐতিহাসিক দিন।

প্রবাসী সরকার গঠনের পর বিদেশের মাটিতে নয়, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যাতে নতুন সরকারের শপথ পাঠ করানো হয়, তা একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য শপথগ্রহণের দিনক্ষণ নির্ধারণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ারে ছিল। সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীর সতর্ক দৃষ্টি ছিল পুরো অঞ্চল ঘিরে। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। শপথগ্রহণ শেষে সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের সদর দপ্তর তথা অস্থায়ী কার্যালয় বৈদ্যনাথতলাকে বঙ্গবন্ধুর নাম অনুসারে মুজিবনগর নামকরণ করেন। সেই থেকে এ সরকার মুজিবনগর সরকার নামে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। মুজিবনগর সরকারের সদর দপ্তর মুজিবনগরে স্থাপিত হলেও পরে কলকাতা স্থানান্তরিত হয়। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল কেবল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে, যা প্রবাসী সরকার গঠনের ইতিহাসে বিরল। এমনকি এ সরকারের প্রধান সেনাপতিও ছিলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। মুজিবনগর সরকারের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো ছয় সদস্যের মন্ত্রিসভা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও স্বশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্রপতি পাকিস্তানে কারান্তরীণ থাকার কারণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত)। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা, তথ্য, সম্প্রচার ও যোগাযোগ, অর্থনৈতিক বিষয়বলি, পরিকল্পনা বিভাগ, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ, সংস্থাপন এবং অন্যান্য যেসব বিষয় কারো ওপর ন্যস্ত হয়নি তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। খন্দকার মোশতাক আহমদ পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এম মনসুর আলী অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; এএইচএম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়। কর্নেল এমএজি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল ১২টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এ সরকারের কর্মকাণ্ড তিন ধরনের বিভাজন ছিল- বেসামরিক প্রশাসন, সামরিক বিষয়াবলি (প্রধান বিষয়) এবং স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক তৎপরতা।

অনুষ্ঠানে শপথবাক্য এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এবং শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আব্দুল মান্নান। মুজিবনগর সরকারের অন্যতম সফলতা হলো বাংলার শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনতার মুক্তির বাসনাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমর্থন লাভ এবং মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা অর্জন। মুজিবনগর সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশন স্থাপন করে এবং বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে বিশ্বজনমতকে বাংলাদেশের সপক্ষে টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধন, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ জনগণের মনোবল ঠিক রেখে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করা ছিল এ সরকারের প্রধান সফল্য।

মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুজিবনগর সরকার যেমন সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করেছিল, একইভাবে সরকার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় ও বিভিন্ন বিভাগ গঠন করে বেসামরিক প্রশাসনকে সংগঠিত করে দেশের নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, নিজস্ব আয়-ব্যয়ের ব্যবস্থা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা, প্রায় এক কোটির মতো শরণার্থীর জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা অর্জন, এসব দিক বিবেচনায় মুজিবনগর সরকার ছিল সত্যিই অতুলনীয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। প্রেরণার বাতিঘর হয়ে থাকবে মুজিবনগর সরকার। তাই বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মুজিবনগর সরকারের নাম।