বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন

* ঢাকায় দুর্ভোগ, চট্টগ্রামে বন্যা * পানিবন্দি লাখো মানুষ * নতুন এলাকা প্লাবিত

প্রকাশ : ১০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে টানা বৃষ্টিতে মূল রাস্তা থেকে অলিগলির রাস্তা ডুবে যায়। রাজধানীর নিচু এলাকাগুলোয় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে বিপাকে পড়ে নগরবাসী। বৃষ্টির পানিতে তলিয়েছে সেগুনবাগিচা, শাহবাগ, বাংলামটর, ধানমন্ডি, মগবাজার, মতিঝিল, কাকরাইল, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, বেইলি রোড, পল্টন, প্রেসক্লাবের সামনেসহ ঢাকার অধিকাংশ এলাকা। রাজধানীর পাশাপাশি কয়েক দিন টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণাঞ্চল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-বরিশালে লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। আর উত্তরাঞ্চলের নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। এমন টানা বৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন কৃষক ও মাছ চাষিরা। কারণ আমনের জমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ধানের চারা পচে যাচ্ছে এবং পুকুরের বাঁধ ভেঙে মাছ ভেসে গেছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানি যেসব নদী দিয়ে প্রবাহিত হবে, ওইসব নদী পলিতে ভরাট হয়েছে। পলিতে নদী সরু নালার মতো হয়েছে। অথচ নদী খননের নামে পাইলট চ্যানেলের কাজ করা হচ্ছে, যা কোনো স্থায়ী বা টেকসই সমাধান নয়। ফলে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল হলেই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কিছু অংশ পানিতে ডুবে যাওয়ায় দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম তিন জেলাসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৭ হাজারের মতো মানুষকে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজারে বন্যা মোকাবিলায় কাজ করছে সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন। অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে রাঙামাটিতে টানা ৭ দিনের ভারি বর্ষণ প্রায় ৪০০ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে।

পাহাড়ি ধস ও টানা বৃষ্টিতে অর্ধশতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি। বসতবাড়িতে পানি ওঠায় মানুষ মাচা ও টিনের চালে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ কেউ বাঁধ ও সড়কের উঁচু স্থানে গিয়ে উঠেছেন। গতকাল বুধবার থেকেই জেলার সব কয়টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাহাড়ি ধসে চট্টগ্রাম শহরে পানি প্রবেশ করায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় কোথাও উঁচু জায়গা না থাকায় তাদের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। অধিকাংশ পরিবারের রান্নার ব্যবস্থা নেই। গৃহপালিত পশু-পাখি রাখার জায়গাও নেই। এখানকার বয়স্ক বাসিন্দারা বলেছেন, বিগত ৪০-৫০ বছরেও তারা এমন বন্যা দেখেননি। পানিবন্দি মানুষের মাঝে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা চাল-ডাল-তেল-চিড়া-মুড়ি-বিস্কুটসহ শুকনো খাবার বিতরণ করতে দেখা যায়।

চট্টগ্রাম : টানা ছয় দিনের বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবন। নিম্নাঞ্চলসহ অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা থাকায় ষষ্ঠ দিনেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে প্রবেশ করা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়তে হয়। পাহাড়ি ঢল প্রবাহিত হওয়ায় গতকাল বুধবার সন্ধ্যা থেকে দূরপাল্লার যানবাহন ধীর গতিতে চলাচল করতে দেখা গেছে। একইসঙ্গে স্থানীয় ছোট ছোট কিছু যানবাহন চলাচল করছে ঝুঁকি নিয়ে।

চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পাহাড়ি ঢলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত শঙ্খ ও ডলু নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ কারণে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী উপজেলার সিংহভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বিরতিহীন বৃষ্টির সঙ্গে প্রবল জোয়ারের কারণে বন্যার পানি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল সকাল থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে তীব্র দুর্ভোগে পড়েছে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তরফ থেকে পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে কোথাও কোথাও চাল ও খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

চন্দনাইশ উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জিরান মোহাম্মদ সায়েক জানান, চন্দনাইশ এলাকার বিস্তীর্ণ অংশে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এছাড়া সমগ্র উপজেলার ওপর দিয়ে ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার বাস স্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চলাচলকারী দূরপাল্লার সব যানবাহন জট বেঁধে থেমে আছে। বাস কাউন্টারগুলোতে শত শত যাত্রী ভিড় করছে। এর মধ্যে হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাস কাউন্টারের টিকিট বিক্রেতা মাসুদুর রহমান বলেন, মহাসড়কে পটিয়া থেকে লোহাগাড়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকার ১০-১২টি অংশ ৫-৬ ফুট পানির নিচে ডুবে গেছে। যেখানে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

এর আগে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সহকারী পরিচালক রাশেদুল আলম খানের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদের নির্দেশে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে বন্যা পরিস্থিতি ও ভূমিধস মোকাবিলায় অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার লক্ষ্যে গত মঙ্গলবার থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।

এ ছাড়াও সেনাবাহিনীর অন্যান্য ফরমেশনগুলো নিজস্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছেন বলেও এতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে চট্টগ্রামে টানা বৃষ্টি শুরু হয়। অস্বাভাবিক উচ্চতার জোয়ার যোগ হলে গত শুক্রবার বন্দরনগরীর বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। বুধবারও এসব এলাকা ছিল পানির নিচে। বন্দরনগরীর নতুন নতুন এলাকা তলিয়ে যায়, পানির নিচে চলে যায় সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, পটিয়া, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ার বেশ কিছু এলাকা।

কক্সবাজার : ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ৯ উপজেলার ৬০ ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি থাকা গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও খাবার পানির সংকট। রাস্তা ভাঙা ও পানিতে ডুবে থাকায় চলাচলের উপায় না পেয়ে এসব গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। একাধিক অংশে ভেঙে গেছে মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ। এসব ভাঙন দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাথমিক হিসাবে ৫১ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক এবং আড়াই কিলোমিটার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুর্গতদের মাঝে এরইমধ্যে ৫৮ টন চাল ও ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া সামুদ্রিক জোয়ারের ঢেউয়ে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, জেলার ৬০ ইউনিয়নে তিন লক্ষাধিক মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় প্রাণহানি হয়েছে পাঁচজনের। দুর্গত মানুষের জন্য ২০৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ঘরবাড়ি, হাটবাজার ও দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, খামার। এছাড়া বন্যার কারণে গো-খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গত মানুষজন গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে উঁচু এলাকায় অবস্থান নিয়েছে। প্লাবিত এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বানের পানিতে নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় এসব এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

খাগড়াছড়ি : টানা বৃষ্টিতে খাগড়াছ?ড়ির মা?টিরাঙাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধ?সের ঘটনা ঘ?টে?ছে। এতে মাটিরাঙার ৯১টি পরিবারসহ পুরো জেলায় পাঁচ শতাধিক পরিবার ঝুঁকিতে রয়েছে।

রাঙামাটি : গত বৃহস্পতিবার থেকে ৭ দিনের টানা ভারি বর্ষণে রাঙামাটি জেলা সদরসহ ১০ উপজেলার ৩৭১টি স্পটে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। বিলাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বাঘাইছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে প্রায় ২৮ হাজার ১৫০ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ১৭ পরিবারের ৬০ জনকে পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে টানা বৃষ্টি আর ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ফেনীর মুহুরী নদীর ফুলগাজী ও পরশুরামের তিনটি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে।