শোকাবহ আগস্ট

বঙ্গবন্ধুর লেখা বই সময়ের দলিল

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারাজীবন শুধু রাজনীতিই করেননি, তিনি লেখালেখির সঙ্গেও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। নির্জন কারাগারে থাকার কারণে সেই সুযোগটি তিনি হয়তো পেয়েছিলেন। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সরবরাহ করা কাগজেই তিনি লিখে গেছেন তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের গুলিতে নিহত হওয়ার পর তার পা-ুলিপিগুলো অবহেলা ও অযত্নে পড়েছিল। সেগুলো কোথায় ছিল সেটাও জানা ছিল না। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পা-ুলিপিগুলো অনেক কষ্টে জোগাড় করেন এবং পরবর্তী সময়ে তা পুস্তক আকারে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধু নিজে তিনটি বই লিখেছেন। তার বইগুলো নিঃসন্দেহে সময়ের দলিল। বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই সুখপাঠ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ। তৎকালীন সমসাময়িক ঘটনার সাক্ষ্য দেয় এসব বই। বইগুলোতে একদিকে ব্যক্তি হিসেবে শেখ মুজিবের চিন্তার মগ্নতা গভীরভাবে রূপায়িত হয়েছে, অন্যদিকে তখনকার সময়ের পটভূমিতে নিজের রাজনৈতিক জীবন চমৎকারভাবে তিনি তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি চোখ রেখেছেন সর্বত্র। খুঁটিনাটি নানা ঘটনা চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে তার প্রতিটি বই হয়ে উঠেছে অনন্য। এই বইগুলোতে শুধু একজন রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, লেখকের দায়বোধের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধুর প্রথম বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। এটি লেখা হয়েছে ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে যখন তিনি কারারুদ্ধ। আত্মজীবনীর শুরু হয়েছে তার জন্মের সময় থেকে; পাশাপাশি এসেছে পিতৃপুরুষের কথাও। আর বইটি শেষ হয়েছে ১৯৫৪ সালের ঘটনাবলি দিয়ে। আত্মজীবনীটি বঙ্গবন্ধু শেষ করতে পারেননি। কিন্তু সরল প্রাঞ্জল ভাষায় নির্মোহভাবে ঘটনাবলির বর্ণনা ও সময়ের ঐতিহাসিক বিবরণ থাকার কারণে পাঠক সহজেই তা বোধগম্য করতে পারবে।

জীবনী লেখার পটভূমি তিনি উল্লেখ করেছেন বইয়ের ভূমিকায়, ‘বন্ধুবান্ধবরা বলে, ‘তোমার জীবনী লেখ।’ সহকর্মীরা বলে, ‘রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাগুলো লিখে রাখ, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।’ বললাম, লিখতে যে পারি না; আর এমন কী করেছি, যা লেখা যায়। আমার জীবনের ঘটনাগুলো জেনে জনসাধারণের কি কোনো কাজে লাগবে? কিছুই তো করতে পারলাম না। শুধু এইটুকুই বলতে পারি, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছি। টুঙ্গিপাড়ায় শৈশব ও কৈশোরের জীবন-প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। বোধ করি এ কারণেই প্রকৃতির বর্ণনা তার রচনায় বড় স্থান দখল করেছে। এই বর্ণনা তার লেখা তিনটি বইয়েই পাওয়া যায়।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীজুড়েই আছে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। এখানে নিজের জীবনদর্শনের এমন অনেক প্রসঙ্গ আছে, যা একজন ব্যক্তিকে বোঝা সহজ করে দেয়। এভাবে বাঙালির মানসচেতনায় সময়ের দলিল হয়ে উঠেছে তার এ বই।

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বই কারাগারের রোজনামচা (২০১৭)। এই গ্রন্থের নামকরণ করেছেন শেখ রেহানা। এই বইও বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে রচনা করেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতো এটিও নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে প্রকাশিত হয়। এই বইও বঙ্গবন্ধু লিখেছেন স্বাচ্ছন্দ্যময় ভাষায়। এখানেও চমৎকারভাবে বিবৃত হয়েছে প্রকৃতির অনুষঙ্গ, ‘আমার ঘরের কাছের আমগাছটিতে রোজ ১০টা, ১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালোবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে এ দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।’ আমগাছে কাকের উৎপাত প্রসঙ্গেও বর্ণনা আছে। কাকগুলোর চিৎকারে তিনি খুব বিরক্ত হতেন। বাগানি কাদের মিয়াকে তিনি কাকগুলোর বাসা ভেঙে দিতে বলেন। বাসা ভাঙার পর কাকেরা জড়ো হয়ে একসঙ্গে চিৎকার করত। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কিছু সঙ্গী জোগাড় করে ওরা কাদেরকে গাছে আক্রমণ করত। দুই-একদিন শত শত কাক জোগাড় করে প্রতিবাদ করত। ওদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়ে ওদের একতা বেশি।’ এভাবে কারাবাসে দিন কাটানোর সময়গুলোতে তিনি দেখেছেন এবং উপলব্ধি করেছেন বিচিত্র কিছু। সেসব সরসভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে তার রচনায়। তার লেখায় কৌতুকও পাওয়া যায়। কাকেদের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘কিছুদিন পর্যন্ত কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত, ভাবত আমি বুঝি ওদের ঘর ভাঙব। এখন আর আমাকে দেখলে ওরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না, আর নিন্দা প্রস্তাবও পাস করে না। এমন রসিকতাও তার কলমে উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের জীবনও উপলব্ধি করেছেন জেলখানায় বসে। তার লেখা থেকে উদ্ধৃত করা যায়, ‘কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা খাওয়ার চিন্তা করতে হবে। এমন অনেক লোক আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে করুণ কাহিনি কল্পনা করতেও ভয় হয়। পুরো বইয়ের অনেক জায়গায় এমন অনেক মন্তব্য আছে, যেটা পড়লে রাজনীতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে দার্শনিক যোগ, সেগুলো বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় বই আমার দেখা নয়াচীন (২০২০)। এটিও কারাগারে রাজবন্দি থাকার সময়ে রচিত। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীনের পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। সে সময় নয়াচীন দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে বইটি রচিত। তবে এখানে তিনি শুধু ভ্রমণ বৃত্তান্তই তুলে ধরেননি, নয়া চীনের সমাজ-দর্শনও এসেছে। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকদর্শন ও মূল্যায়নমূলক পর্যালোচনাও সমৃদ্ধ করেছে বইটিকে। এতে মাতৃভাষার মর্যাদার প্রশ্নে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন বঙ্গবন্ধু, ‘চীনে অনেক লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, অনেকেই ইংরেজি জানেন, কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলবেন না। দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলবেন। আমরা নানকিং বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ইংরেজি জানেন, কিন্তু আমাদের অভ্যর্থনা করলেন চীনা ভাষায়। দোভাষী আমাদের বুঝাইয়া দিল। দেখলাম তিনি মাঝেমধ্যে এবং আস্তে তাকে ঠিক করে দিচ্ছেন, যেখানে ইংরেজি ভুল হচ্ছে। একেই বলে জাতীয়তাবোধ। একেই বলে দেশের ও মাতৃভাষার উপর দরদ’। আমার দেখা নয়াচীন-এর শেষ পর্যায়ে এসে তার মন্তব্য উল্লেখ করার মতো, ‘নয়াচীনের উন্নতি দেখে সত্যিই আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। যদি ১০ বছর তারা দেশকে শান্তিপূর্ণভাবে গড়তে পারে, তবে দেশের জনসাধারণের কোনো দুঃখ দুর্দশা থাকবে না, অশিক্ষা-কুসংস্কার মুছে যাবে এবং দুনিয়ার যেকোনো শক্তির সঙ্গে তারা মোকাবিলা করতে পারবে সব দিক থেকে, কারণ জাতিকে গড়ে তোলার যে প্রধান শক্তি জনসাধারণের মনোবল, তা নয়াচীনের জনগণের মধ্যে আছে।’

বঙ্গবন্ধু এখানে তার রাজনৈতিক দর্শনের আলোকে নয়াচীনের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন। এখানেই তার এ বই হয়ে উঠেছে দার্শনিক বোধে প্রদীপ্ত। উল্লিখিত তিন বইয়ে সহজ ভাষাভঙ্গি, বিভিন্ন ঘটনাকে ছবির মতো ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা, মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ ওই সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর অনবদ্য রচনাশৈলীর প্রতীক, যা লেখক হিসেবে তার সার্থকতাকেই প্রকাশ করে।