চট্টগ্রাম মহনাগরীতে টানা জলাবদ্ধতার নেপথ্য কারণ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ ধাপের সময় ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় নানা প্রশ্ন উঠছে। কারো মতে প্রকল্পের অর্থ জলে গেছে। আবার কারো মতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান যথার্থ ছিল না। এ কারণে প্রকল্পের সুফল মিলছে না। কারো ধারণা প্রকল্প কাজ পুরোপুরি অর্থাৎ শতভাগ শেষ হলেই সুফল মিলবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত সমালোচনাই হোক প্রকল্পের সুফল মিলছে তাতে সন্দেহ নেই। খাল সংস্কার করার ফলে বহু এলাকায় এবার তেমন জলাবদ্ধতা হয়নি। যেখানে খালের মুখ আটকা ছিল কেবল সেখানেই জলাবদ্ধতা হয়েছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) জলাবদ্ধতা প্রকল্প নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে বিতর্কে। দুই প্রতিষ্ঠানের বিতর্ক ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
২০১৭ সালে চট্টগ্রাম নগরীতে পুরোদমে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প কাজ শুরু হয়। শুরুতে প্রকল্প কাজের ব্যয় ধরা হয় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এরপর বিভিন্ন ধাপে প্রকল্প কাজের ব্যয় বাড়তে থাকে। ব্যয় বেড়ে বর্তমানে প্রকল্প ব্যয় ১১ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে। তবে প্রকল্প কাজ এখন শেষ ধাপে। অর্থাৎ প্রকল্প কাজ এখন প্রায় শেষের পথে। শেষ মুহূর্তের কাজ চলাকালে ভয়াবহ জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়ে পড়ে চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দারা। টানা চার দিন চট্টগ্রাম নগরী ছিল পানির নিচে। জলাবদ্ধতার সঙ্কট কেটে গেলেও নগরীর সড়কগুলোতে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত। জেলা প্রশাসন এরইমধ্যে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতির পরিমাণ ১৩৫ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে প্রকল্পের সুফল নিয়ে। প্রকল্প শেষ ধাপে থাকা অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীর অর্ধেকের বেশি অংশ কেন ডুববে তা নিয়ে প্রশ্নের যেন শেষ নেই। ভারি বর্ষণ বন্ধ হওয়ায় নিচু এলাকায় দুই দিন ধরে জলাবদ্ধতা নেই। তা সত্ত্বেও জলাবদ্ধতা নিয়ে বিতর্ক যেন থামছে না। নগরবাসীর এই বিতর্কের মধ্যে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে দুই সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। গেল ৯ আগস্ট এ ব্যাপারে সিডিএর পক্ষ থেকে প্রকল্প নিয়ে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ দাবি করেন প্রকল্প বাস্তবায়নে চসিক অযোগ্য বলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) কাজ দিয়েছে। ওইদিন সিডিএ সম্মেলনে কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি করেন। জলাবদ্ধতা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন হলেও মূলত একটি স্থানীয় পত্রিকায় সিডিএর বিরুদ্ধে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর দেওয়া বক্তব্য নাকচ করতেই সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে মেয়রের দেওয়া বক্তব্যকে মিথ্যা বলে দাবি করে তিনি বলেন, সিডিএ জলাবদ্ধতার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তাই সবাই মনে করেছে সব দায় সিডিএর। মূলত সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতার কাজ করতে না পারায় সিডিএকে প্রকল্প কাজ দেওয়া হয়। সিডিএ শুধু একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মেয়র ভুল তথ্য দিয়ে সিডিএকে দোষারোপ করছেন।
সিডিএ বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যোগ্য না চসিক মেয়রের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিডিএর বক্তব্য জানতে চাইলে দোভাষ বলেন, সিডিএ যোগ্য না হলে সরকার প্রকল্প দিয়েছে কেন? বরং তারা যোগ্য নয় বলে তৎকালীন সময়ে সিডিএকে প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, আমরা কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে না বা কোনো সংস্থাকে দোষারোপ করছি না। আমরা শুধু কি কাজ তা জানাচ্ছি। স্লুইসগেট বসানোর কারণে চাক্তাই খাতুনগঞ্জে এবার পানি ওঠেনি। যদিও সেখানে অস্থায়ী গেট বসানো হয়ছে।
সংবাদ সম্মেলনে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ আলী বলেন, প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি হয়। আমাদের প্রকল্পে রয়েছে ৩৬টি খাল। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরে প্রায় ৫৭টি খাল রয়েছে। ৩৬টি খালের সম্প্রসারণ চলছে কিন্তু বাকি ২১টি খালে সম্প্রসারণ করা হয়নি। যা আমাদের প্রকল্পের আওতাভুক্ত না। যার জন্য জলাবদ্ধতা হতে পারে। সেনাবাহিনীর বাস্তবায়নাধীন ৩৬টি খালের মধ্যে ২৬টি খালের কাজ প্রায় শেষ। বাকি ১১টি খালের কাজ ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে আছে। ভূমি অধিগ্রহণ শেষ হলে আমরা কাজ শেষ করতে পারবো। তিনি বলেন, নগরে জলাবদ্ধতা কমাতে হলে খালে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। এছাড়া নগরের ছোট বড় প্রায় ১৬০০ নালা রয়েছে। এসব নালা পরিষ্কারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এদিকে সিডিএ চেয়ারম্যানের জলাবদ্ধতা প্রকল্প নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। ৯ আগস্ট তিনি নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নগরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ছাড়া অন্য কোনো সংস্থায় নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। তাই মেয়রের প্রতি নগরবাসীর প্রত্যাশা থাকে, আবদার থাকে, গালাগালও করে। আবার প্রশংসাও করে। কারণ জনগণের এমন আচরণের অধিকার রয়েছে। ৯ আগস্ট জলাবদ্ধতা প্রকল্প বিষয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনের পর ওইদিন বিকালেই টাইগারপাসে নিজের দপ্তরে মেয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন।
কারো প্রতি দোষারোপের সংস্কৃতি বিশ্বাস করি না মন্তব্য করে মেয়র বলেন, সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী একজন সরকারি কর্মচারী, উনি কোনোভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলরদের নিয়ে উঁচু গলায় কথা বলতে পারেন না। সিটি কর্পোরেশনকেও দোষারোপ করতে পারে না।
সিটি কর্পোরেশন ঠিকভাবে নালাগুলো পরিষ্কার করছে না, সিডিএর এমন অভিযোগে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বেশিরভাগ খাল-নালা জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অধীনে। এর বাইরে এক থেকে তিনফুটের নালাগুলো আমাদের। এগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতা না থাকায় প্লাস্টিক, বাসা-বাড়ির বর্জ্য ফেলায় ভরাট হয়ে যায়। ধরে নিলাম তাদের (সিডিএর) কথা সত্য, পানির ধর্মই হলো নিচের দিকে ধাবিত হওয়া। ছোট নালাগুলো ভরাট হলে রাস্তায় পানি উঠে। স্বাভাবিকভাবে গড়িয়ে পানি খালে যাবে। তবুও জলাবদ্ধতা কেন? কারণ খালগুলোর দুই পাশে ওয়াল দেওয়া হয়েছে, সড়ক করা হয়েছে। কিন্তু মাটি উত্তোলন করা হয়নি। অর্থাৎ খালগুলোতে পানির ধারণক্ষমতা বাড়েনি। ফলে জলাবদ্ধতা কমছে না। জলাবদ্ধতার কারণ নিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘সিডিএ’র তাদের প্রকল্পের আওতাধীন খাল থেকে সাড়ে ৯ লাখ কিউবিক মিটার মাটি উত্তোলনের কথা। তার চার ভাগের এক ভাগ মাটিও তুলেনি। এগুলো দৃশ্যমান বিষয়, কাউকে দোষারোপ করা নয়। খালের গভীরতা বাড়েনি। ফলে পানির স্পেস কমে গেছে। এগুলো আমি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভাতেই বলেছি। আরেকটা কারণ হলো স্লুইস গেটসমূহ এক্টিভ করা হয়নি এবং পানি পাম্প আউট করার জন্যও কোনো ব্যবস্থা এ পর্যন্ত করেনি। ফলে পানি ধীরে নামছে। এটাই মূলত জলাবদ্ধতার কারণ।
প্রকল্প চলমান অবস্থায় অন্য সংস্থা কাজ করতে পারে না মন্তব্য করে মেয়র আরও বলেন, ‘আমরা চাইলেও প্রকল্প চলমান কাজ করতে পারি না। যে সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, চলমান অবস্থায় সব মেইনটেনেন্স তারাই করবে। সুস্পষ্টভাবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে, কোনোভাবেই ওভারলেপিং করা যাবে।
সাংবাদিকদের খালগুলো পরিদর্শন করার আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘আমি আজকেও (গত বুধবার) চাক্তাই খালের চামড়া গুদাম এলাকায় পরিদর্শন করেছি। পুরো শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি করেছে। অথচ, চাক্তাই খালে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি নেই। কারণ শাখা খালগুলোর পানি বড়খালে আসতে পারছে না।
এছাড়া নগরের প্রতিটি নালায় গ্যাস, পানি ও অন্যান্য সংস্থার ইউটিলিটি লাইন রয়েছে। যা পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে। তাই পানির প্রবাহপথ থেকে এসব পাইপ সরাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চিঠি দেওয়া হবে।